ডোম
পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা
১
সকল রং এক সরলরেখায় এসে সাদা হয়ে যায়
এসব কথা লাশের কাফনে-বাতাসের রঙে লেখা আছে।
বাতাস রঙের লেখা পাঠ করতে পারে এক ডোম
অথচ সে বলতে পারে না, মানুষ কেন মরে গেলে সাদা হয়ে যায়।
যদিও তার পূর্বপুরুষ মৃত মানুষের হাতের রেখা দেখে প্রথম ভেবেছিল
পৃথিবীর একটি মানচিত্র দরকার
সেই থেকে পৃথিবীর মানচিত্র হলো হাতের রেখার মতো।
তোমার ও আমার রক্তের ভেতর এসব ইতিহাস লেখা আছে
তাই মানুষ মারা গেলে মৃতদেহ সাদা হয়ে যায়,
রজনীগন্ধার পাপড়ির মতো সাদা ও সুগন্ধ ছড়ায় আমাদের মৃতদেহ থেকে।
যদিও এসব গন্ধ জীবিত মানুষের খুবই অসহ্য
তাই জীবিতরা মৃতদের ভাসায় অগ্নিস্নানে কিংবা পুঁতে রাখে কবরে।
২
নিঝুম নদীতীরের সাথে ঢেউয়ের অভিমান বেজেই চলে
তীর প্রায়ই বলে : ঢেউ—তুমি আমাকে অভিমানে স্পর্শ করো না।
আমরা সেই শান্ত নদীতে হাঁসের মতো ভেসে চলি—ধীরে ধীরে।
আমাদের ভেসে যেতে হয় স্রোতের টানে—ভাটির পানে ফেরার ক্ষমতা নাই।
তবুও সন্ধ্যা হলেই নিঝুম দ্বীপের শ্মশান থেকে শব্দ আসে
চৈ-চৈ-চৈ-চৈ।
আর আমরা সেই শব্দে প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক করে ডেকে উঠি।
আমরা ডাকতে ডাকতে দূরে বহুদূরে ভেসে যাই
যেখান থেকে চৈ-চৈ ধ্বনি আর শোনা যায় না।
চতুর্দিকে অবারিত রক্তমেঘ আর ধু-ধু জলরাশি
আমরা এই জলরাশির গভীরে কেন অনন্ত নিঃসঙ্গতায় ডুবতে পারি না!
আমরা কেন নবলব্ধ আকাশে মানুষের মতো উড়তে পারি না!
তাই আমার এই হাঁস জনমের বেদনা-ফাঁস করে গেলাম কবিতায়
যে কবিতা পাঠ করলেই শুনতে পাবেন : চৈ-চৈ-চৈ-চৈ।
৩
একজন কবি তার কবিতায় চিতার কাঠ জ্বালাতেই
হঠাৎ অনুভব হলো চিতার কাঠ যেন তার শরীরের হাড়।
চিতার কাঠ যখন কবিতায় দাউদাউ করে জ্বলছে
তখন কবিও পুড়ে যাচ্ছে, টগবগ করে ফুটছে রক্ত ও মাংস
সেই থেকে পৃথিবীর সকল কবির রক্ত ও মাংস থেকে পোড়া গন্ধ।
অথচ আমার রক্ত ও মাংসে পোড়া কোনো গন্ধ নেই—
যদিও আমি গল্পের নামে কবিতা লিখি—কবিতার নামে গল্প।
একদিন আমার একটি কবিতার মাঝে এক রমণীকে হত্যা করেছিলাম
সেই থেকে ওই রমণী আমার স্বপ্নঘরে এসে বসে থাকে
এবং তার হত্যার বিচার চায় আর আমায় অভিশাপ দিয়ে বলে—
‘একজন খুনি কীভাবে কবি হতে পারে’।
তারপর—কচুপাতায় আমার চোখের জল জমে জমে নদী হয়ে যায়
আর আমি হয়ে যাই সকল মৃত কবিতার ডোম।
৪
আমার ধাত্রীমা, বিধবা ও নিঃসন্তান ছিলেন
পৃথিবীতে তিনিই প্রথম আমাকে স্পর্শ করেছিলেন রক্তমাখা হাতে
মাতৃগর্ভ থেকে মায়ের মুখোমুখি করেছিলেন আমাকে।
তারপর কোনো দিন তার স্পর্শ পাইনি
বিস্মৃত সময়ের অন্তরালে তাকে ভুলে গিয়েছি—অকৃতজ্ঞতায়।
অনেক পরে ধানলিপি থেকে জেনেছি তার গল্প—
তিনি অন্তঃসত্ত্বা হতে হতে স্বামী হারিয়েছিলেন—বোবা পৃথিবীতে
এক মৃতশিশুর জননী হয়েছিলেন—গম্বুজীয় অন্ধকারে।
তারপর সেই মৃতশিশুকে চুমু খেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন—
তুই কি জানিস, একফোঁটা চোখের জলে কতটুকু বেদনা ঝরে?
আপনারা কেউ কি আমাকে বলবেন?
কোনো মৃতশিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মা মনে মনে কী কী ভাবে?
৫
আমার স্মৃতির ভেতর নদীর স্রোতে তোমার ভেসে যাওয়া
এ যেন আমি ডোম বংশের বেহুলা তুমি লখিন্দর।
আমার কামের ভেলায় তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছি—
যেখানে কবিতার অনুরাগে মৃতদেহ প্রাণ ফিরে পায়।
এই ইতিহাস আমি লিখে রাখি কবিতায়
সেই কবিতায় তোমার স্মৃতির স্পর্শে—
আমার কলমের কালি রক্ত হয়ে যায়।
আমার নিভৃত প্রার্থনায় তোমার এই রহস্যাবৃত জন্ম ও মৃত্যু
কেন যেন আমাকে মহাপ্রকৃতির কাছে নত করে দেয়।
হে অগ্নিপ্রভ জীবন জিজ্ঞাসা তুমি আমাকে বলো :
প্রাণ যদি দেহের ভেতরে বাঁচে
তবে কেমন করে দেহের বাহিরে প্রাণ বেঁচে রয়।
তাই আমার এই বালকোচিত মনোবেদনা—থেকে থেকে মৃন্ময়ী হয়ে
বেহুলা ও লখিন্দরের ভাসানযাত্রায় অভিনীত হয়, অভিনীত হতে হয়।