ঢাকার কথা ৬
কীর্তিতে উজ্জ্বল শায়েস্তা খান
সুবা বাংলার দায়িত্ব পাওয়া সুবাদারদের মধ্যে আপন কীর্তিতে উজ্জ্বল ছিলেন শায়েস্তা খান। তিনি দুই পর্বে বাংলার সুবাদারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সবচেয়ে বেশি সময় বাংলার সুবাদারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খান সুবাদারের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসেন। টানা ১৪ বছর পর এক বছরের জন্য তিনি দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। এ সময়টুকু বাদ দিলে শায়েস্তা খান প্রায় ২৪ বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। শায়েস্তা খান একদিকে ছিলেন সুশাসক, অন্যদিকে একজন বিজয়ী যোদ্ধা ও নিপুণ নির্মাতা।
মীর জুমলা হঠাৎ মারা গেলে মোগল কর্মকর্তাদের ওপর সুবাদারি পরিচালনার সাময়িক দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এদের অসততা ও অদক্ষতার কারণে বাংলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমন এক সংকটপূর্ণ সময়ে শায়েস্তা খান ঢাকায় আসেন। শায়েস্তা খান সুবাদারের প্রকৃত নাম নয়। তাঁর নাম মির্জা আবু তালিব। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে ‘শায়েস্তা খান’ উপাধি দেন। ঢাকায় এসে শায়েস্তা খান শক্ত হাতে সব বিশৃঙ্খলার মোকাবিলা করেন। এ সময় সুবা বাংলা অনেক সরকার বা প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। শায়েস্তা খান তাঁর ছয় পুত্রকে ছয়টি সরকারের প্রশাসক নিয়োগ করেন। শায়েস্তা খানের সবচেয়ে বড় সামরিক সাফল্য হচ্ছে আরাকানিদের হাত থেকে চট্টগ্রাম অধিকার। তা ছাড়া তিনি সীমান্ত অঞ্চলের বেশ কজন বিদ্রোহী রাজাকে দমন করেছিলেন।
বাংলার ইতিহাসে সফল নির্মাতা হিসেবে শায়েস্তা খানের খ্যাতি রয়েছে। রাজধানী ঢাকাকে তিনি পরিকল্পনামতো সাজাতে চেয়েছিলেন। তাঁর সময়ে নির্মিত মসজিদ, সমাধি ও অতিথিশালা ছোট কাটরা সুবাদারের কীর্তি প্রচার করছে।
শায়েস্তা খান ছোট কাটরা নির্মাণ করেন ১৬৬৪ সালে। কাটরা এলাকায় এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি ছোট আকারের মসজিদ রয়েছে। শায়েস্তা খান নির্মিত এই মসজিদ চমৎকার কারুকার্য খচিত। তিনি মিটফোর্ড থেকে লালবাগ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীরে বাঁধ নির্মাণ করেন। শায়েস্তা খানের একজন পালিত কন্যা ছিলেন বিবি চম্পা। বিবি চম্পার সমাধিও রয়েছে কাটরা প্রাঙ্গণে। লালবাগ দুর্গ নির্মাণের সঙ্গেও শায়েস্তা খান যুক্ত ছিলেন। এই দুর্গ নির্মাণ শুরু করেছিলেন শাহজাদা মুহম্মদ আজম; কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। এই অসম্পূর্ণ দুর্গ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব পড়ে শায়েস্তা খানের ওপর। তিনি দুর্গ নির্মাণ অনেকটা এগিয়ে নিতে পারলেও শেষ করতে পারেননি। এর প্রধান কারণ, শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির মৃত্যু। শাহজাদা আজমের সঙ্গে পরী বিবির বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে লালবাগ দুর্গেই পরী বিবি মারা যান। শায়েস্তা খান এই প্রিয় কন্যাকে হারিয়ে ভেঙে পড়েন। তিনি এই দুর্গকেই অপয়া ভাবেন। তাই বন্ধ করে দেন লালবাগ দুর্গের কাজ।
দিল্লি-আগ্রার তুলনায় ঢাকায় নির্মিত মোগল স্থাপত্যগুলো ছিল অনেকটা সাদামাটা। শুধু এর ব্যতিক্রম ছিল পরী বিবির সমাধি। সমাধি নির্মাণের জন্য তিনি উত্তর ভারত থেকে দামি মার্বেল পাথর আনান। ঢাকায় শায়েস্তা খানের আমলে নির্মিত স্থাপত্যগুলোর মধ্যে পরী বিবির সমাধি বিশেষ শিল্পমান সমৃদ্ধ। এসব নির্মাণের বাইরে আরো কয়েকটি চমৎকার মসজিদ নির্মাণ করিয়ে ছিলেন শায়েস্তা খান। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চকবাজার মসজিদ, সাতগম্বুজ মসজিদ এবং নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জে মোগল জলদুর্গের পাশে অবস্থিত খিজিরপুর মসজিদ। সুশাসক শায়েস্তা খানের আমলে বাংলার মানুষ অনেক বেশি শান্তিতে ছিল। এ সময়ের সস্তা পণ্যমূল্যের কথা ইতিহাসে সুবিদিত। কথিত আছে, এ সময়ে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত।
এসব কৃতিত্বই ঢাকায় নিযুক্ত মোগল সুবাদারদের মধ্যে শায়েস্তা খানকে বিশেষভাবে উজ্জ্বল করেছে।
বাংলাদেশে মধ্যযুগে যেসব ইমারত নির্মিত হয়েছে, নির্মাণ-রীতির দিক থেকে সুলতানি ও মোগলপর্বে তা অভিন্ন ছিল না। সুলতানি যুগে ধর্মীয় ইমারত, বিশেষ করে মসজিদ নির্মিত হয়েছে বেশি। মোগল যুগে ধর্মীয় ইমারতের পাশাপাশি অনেক লৌকিক ইমারতও নির্মিত হয়। তবে মসজিদ নির্মাণ-রীতিতে সুলতানি ও মোগল যুগে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। সুলতানি যুগে ইমারতের দেয়ালে পলেস্তারা ব্যবহার শুরু হয়নি। বাঁকানো ছাদ, পার্শ্ববুরুজ, গম্বুজের আকার ও ধরন ইত্যাদি মিলিয়ে এখানে একটি দেশীয় ধারার প্রতিফলন ছিল। কিন্তু মোগল যুগে উত্তর ভারতের মোগল স্থাপত্যের ধারা প্রবেশ করে বাংলায়। ঢাকায় মোগল যুগে অনেক মসজিদ নির্মিত হয়। এই মসজিদের নির্মাণশৈলীতে উত্তর ভারতীয় প্রভাব স্পষ্ট। ঢাকার মোগল ইমারতের স্থাপত্যরীতি পর্যবেক্ষণ করে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক আহমদ হাসান দানী শায়েস্তা খানের নির্মাণশৈলীকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি এই শৈলীকে বলেন শায়েস্তাখানি রীতি।
শায়েস্তাখানি রীতিতে নির্মিত একটি উল্লেখযোগ্য মসজিদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার বাবুবাজার এলাকায়। মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই মসজিদ অবস্থিত। জায়গাটিকে কাটরা পুকুরতলী নামে পরিচিত।
ইটে তৈরি এই মসজিদে চুন-সুড়কির পলেস্তারা রয়েছে। মসজিদের চার কোণে রয়েছে চারটি কর্নার টাওয়ার বা পার্শ্ববুরুজ। এই বুরুজ-স্তম্ভ আট কোনাকার। বুরুজের মাথায় কলস নকশাসংবলিত ছত্রী রয়েছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে পাঁচটি দরজা। এর তিনটি পূর্ব দিকের প্রবেশপথে এবং দুটি উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে। সবকটি দরজার প্রবেশপথ মোগল রীতিতে খিলান আকৃতির। পূর্ব দিকের মাঝখানের দরজাটি কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ। অন্য দুটির চেয়ে এই দরজা প্রশস্ত। পূর্ব দিকের তিনটি প্রবেশপথের প্রতিটিতেই ভেতরে ও বাইরে দুটি করে খিলান রয়েছে। ভেতরেরটির চেয়ে বাইরের খিলান একটু বেশি উঁচু ও প্রশস্ত। পূর্ব দিকের প্রতিটি দরজা বরাবর পশ্চিম দেয়ালে একটি করে মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় দরজা বরাবর মিহরাব অপেক্ষাকৃত বড়। এটি অর্ধঅষ্টভুজাকৃতির।
শায়েস্তাখানি রীতির এই মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি তুলনামূলক বড়। একসময় গম্বুজের চূড়ায় পদ্ম পাপড়ি ও কলস নকশা ছিল। তবে এখন তা আর অবশিষ্ট নেই। মিহরাব ও এর চারপাশে রঙিন চিনামাটির টুকরা দিয়ে মোজাইক করা হয়েছে, যা চিনি টিকরি মোজাইক নামে পরিচিত।
এই মসজিদে নির্মাণ তারিখসহ নির্মাতার নামসংবলিত একটি শিলালিপি আছে। ফারসি লিপিতে উৎকীর্ণ এই শিলালিপি মূল প্রবেশপথের ওপরে সংস্থাপিত। শিলালিপির সাক্ষ্য অনুযায়ী সুবাদার শায়েস্তা খান মসজিদটি নির্মাণ করেন। নির্মাণ তারিখের বর্ণগুলোর অনেকটাই ভেঙে গেছে। ফলে তারিখটি সুনির্দিষ্ট করার উপায় নেই। তবে শায়েস্তা খানের প্রথম সুবাদারিকালেই (১৬৬৩-১৬৭৮ খ্রি.) যে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ব্রিটিশ শাসনকালে অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়ে মসজিদটি। তখন এই স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। পরে আগের কাঠামো ঠিক রেখে আবার নির্মাণ করা হয়। পুনর্নির্মাণের সময় প্রত্নস্থাপনা সংরক্ষণের বিধি না মেনে পূর্ব দিকে সংযুক্ত করা হয় একটি বারান্দা। এ কারণে শায়েস্তাখানি রীতির মূল সৌন্দর্য অনেকটা ব্যাহত হয়েছে।