গপ্পো তক্ক যুক্তি
আমি একদমই বিশৃঙ্খলা চাই না : টেরি গিলিয়াম
পাগলাটে, খ্যাপা, উদ্ভট, স্বপ্নবাজ- পরিচালক টেরি গিলিয়াম, কিংবা টেরেন্স ভ্যান্স গিলিয়ামকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। তার এমন কোনো ছবি নেই যেটা বানাবার সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি! তাঁর ছবিতে অভিনয় করার সময়ই মারা গিয়েছিলেন হিথ লেজার, ‘ব্রাজিল’ ছবির শুটিংয়ের সময় তিনি নিজেও মরতে বসেছিলেন। তবুও পাগলামি থামেনি ১৯৪০ সালের ২২ নভেম্বর যুক্তরাষ্টের মিনেসোটায় জন্ম নেওয়া এই অসামান্য ফিল্মমেকারের। ‘ব্রাজিল’, ‘টুয়েলভ মাংকিস’, ‘মন্টি পাইথন অ্যান্ড দ্য হোলি গ্রেইল’, ‘ফিয়ার অ্যান্ড লোদিং ইন লাস ভেগাস’, ‘লাইফ অব ব্রায়ান’- তাঁর প্রতিটি ছবিকে এক শব্দে বলা যায় ‘বিস্ময়কর’! এই সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করা হয়েছে ‘দ্য টকস’ থেকে।
প্রশ্ন : মিস্টার গিলিয়াম, আপনাকে ডাকনাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্যাপ্টেন ক্যাওস’ (বিশৃঙ্খলার কাপ্তান) কারণ আপনার শুটিং সেটে সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠার জন্য আপনার কি শুটিং সেটে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা দরকার হয়?
গিলিয়াম : (হাসি) এমনটা নয় মোটেও। আমি একদমই বিশৃঙ্খলা চাই না, আমি সবকিছুই চাই ঠিকঠাক মতো হোক। আমি আসলেই সবকিছু নিয়মানুসারে চাই এবং আমি এও চাই যে আমার আশপাশে সংঘবদ্ধ এবং নিয়মতান্ত্রিক লোকজন থাকুক। এতে আমরা যখন সেটে থাকব, তখন মাথায় যার যে আইডিয়া আসবে সেটা নিয়ে কাজ করতে পারব কারণ আমাদের ভিত্তিটা ভালো। কাজেই এটা বিশৃঙ্খলা নয়। আমার সাথে আমার শিল্পীদের কিংবা কখনো চিত্রনির্দেশকের বিষয়টা এ রকম হয় যে, ‘আচ্ছা, আমরা ব্যাপারটা এভাবে না করে এভাবে করলে কেমন হয়? ঠিক আছে, আমরা করে দেখতে পারি!’ কাজেই অনেক ‘নিয়মতান্ত্রিক’ লোকজন ভাবে যে এটা এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। কিন্তু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। আমি আসলে এমনভাবেই কোনো একটা স্ট্রাকচার তৈরি করি যাতে করে প্রধান অভিনেতা হুট করে মরেটরে গেলেও যেন আমরা ছবিটা শেষ করতে পারি (হাসি)।
প্রশ্ন : আপনার ছবি ‘দ্য ইম্যাজিনারিয়াম অব ডক্টর পামাসুস’ করতে গিয়ে শুটিংয়ের মাঝপথে হিথ লেজার মারা গিয়েছিলেন। আপনি এ সময় কোথায় ছিলেন? এই দুঃখজনক খবরটা জানার পরও কি আপনার মনে হয়েছিল যে আপনি ছবিটা শেষ করতে পারবেন?
গিলিয়াম : কেবল আমাদের লন্ডনের কাজ শেষ হয়েছে তখন। আমি ভ্যানকুভারে গিয়েছিলাম আর হিথ নিউইয়র্কে। দুই দিন বাদে শুনলাম হিথ মারা গেছে। আমি ভ্যানকুভারে আমার ঘরে বসে কাজ করছিলাম। আমার মেয়ে অ্যামি (ও ছবিটার প্রযোজনা করছিল) বলল, ‘বাবা, তোমার একটু এ রুমে আসতে হবে।’ আমি বললাম, ‘কি হয়েছে?’ তখনই ওর ল্যাপটপে দেখলাম বিবিসির খবর, ‘হিথ লেজারকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।’ এটা ছিল একদম অবিশ্বাস্য, কোনোভাবেই তার এমন পরিণতি হওয়ার কথা ছিল না। এটা বিশ্বাস করে উঠতেও সারাদিন লেগে গেল যে হিথ আর নেই। তখন আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে কী করা উচিত। তাই বললাম যে ও (হিথ লেজার) ছবিটার ৪০ ভাগ শুট করেছে- কাজেই এ ছবিটা আমাদের আর শেষ করার উপায় নেই- ইটস ওভার।
প্রশ্ন : আপনার মন বদলাল কেমন করে?
গিলিয়াম : অ্যামি ও অন্যরা আমাকে সরে যেতে দিত না। আমাদের প্রায় সপ্তাহ দেড়েক লেগে গেল, তারপর আমি ভাবতে শুরু করলাম যে এ কাজটা শেষ করার নিশ্চয়ই কোনো না কোনো পথ আছে। কিন্তু আমি কখনোই নিশ্চিত ছিলাম না। এমনকি যখন শুটিং আবার শুরু হলো তখনো আমি একেকবার একেকভাবে কাজ করতে গিয়ে ভেবেছি এটা ‘এভাবে’ করা উচিত ছিল কিন্তু আমরা ‘সেভাবে’ করতে পারব না। আমাদের ক্রমাগতই বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে নিতে হচ্ছিল।
প্রশ্ন : মৃত্যুর পর হিথকে একটা কিংবদন্তীর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে গণমাধ্যম, যেন জেমস ডিনের নতুন সংস্করণ! সে আসলে কেমন ছিল?
গিলিয়াম : ওই সব গল্পই ছিল একদম গাঁজাখুরি। হিথের এই পরিণতির জন্য ওরাই দায়ী..ওই ‘জোকার’ হয়ে অভিনয় করাটাই ওকে (হিথ লেজার) পাগল করে তুলেছিল। একদম ননসেন্স! হিথ একদমই শক্তপোক্ত একটা ছেলে ছিল। ওকে আমার কখনোই খ্যাপাটে মানসিকতার মনে হয়নি। হিথ একদমই ঠিকঠাক ছিল, আর এ জন্যই হিথের এমন পরিণতি মেনে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার বিষয় হলো যে তাদের তো একটা কারণ পয়দা করতে হবে। কিন্তু এর পেছনে কোনো মাদকের ব্যাপার সেভাবে ছিল না। ড্রাগ প্রেসক্রিপশন ছিল বটে- কিন্তু তাতে এমন কিছু এসে যায় না। সত্যি বলতে হিথকে যেমন সবাই মনে করেছে হিথ মোটেও তেমন নয়। সে দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত, ভদ্র, হাস্যোজ্জ্বল, জ্ঞানী, পাথরের মতো শক্ত আর খেলোয়াড়ি মানসিকতার মানুষ। কাজেই তার অভিনয়ের বিষয়টা সেই খেলোয়াড়ি মানসিকতারই অন্তর্গত শুধু। বিষয় একটাই, খেলা যেদিকে মোড় নিয়েছে সেদিকেই সে বেপরোয়ার মতো এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমি ‘কাট’ বলার সাথে সাথেই ব্যাপারটা শেষ এবং আমরা তারপর ফুটবল নিয়ে কথা বলতাম। কাজেই এসব বানানো গালগপ্প নিয়ে মাতামাতির কোনো কারণই আমি দেখি না।
প্রশ্ন : এমনও বেশ কিছু উদাহরণ আছে যে আপনার সেটে হট্টগোল পাকিয়ে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ব্রাজিল করার পর আপনি তো বেশ কিছুদিনের জন্য প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন! আসলে হয়েছিল টা কী?
গিলিয়াম : পুরো ৯ মাস শুটিংয়ের পর আমি আসলে সব কিছুর খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম কারণ আমার আসলে আর কিছু করার ক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল না। আমার শুধু মনে হয়েছিল, এই জিনিস আর কোনোদিনই শেষ করা যাবে না। আমার আর নড়াচড়ারও ক্ষমতা ছিল না, মনে হয়েছিল যে সিনেমাটা মনে হয় বন্ধই করে দিতে হবে।
প্রশ্ন : কেবল এটা নয়, আরো আছে। আপনি ‘দ্য ম্যান হু কিল্ড দন কিহোতে’র শুটিং শুরু করলেন আর ওখানে ঝড় শুরু হয়ে গেল। আপনি সেট একেবারে গুটিয়ে ফেলার আগ দিয়ে মূল অভিনেতা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ‘দ্য ব্রাদার্স গ্রিম’-এর সময় প্রযোজকের সঙ্গে আপনার মারামারি বেধে গেল আর ছবিটাও পিছিয়ে গেল। আপনি কি সাধ করে বিপদ নিজের দিকে ডেকে আনতে চান নাকি সবসময়?
গিলিয়াম : আমি জানি না। আমি হার্জগকে ( ভ্যের্নার হার্জগ) দোষ দিতাম। কারণ ও এমন সব ছবি বানাতো যেগুলোর জন্য ওর ছবির সেটে বিপদ আর দুর্যোগ আপনা আপনি এসে পড়ত। ওর কাজ দেখে আমার হাসি পেত, এমন চলতেইচলতেই আমি দুম করে টের পেলাম যে আমিও অমনটাই হয়ে গিয়েছি! আমি জানি না, এমনটা মোটেও পরিকল্পনা করে হয়নি, এমনটার কোনো আশাও ছিল না। আসলে কিছু জিনিস হয়তো এমনই- এভাবেই হবার, এভাবেই হয়!
প্রশ্ন : তা আপনার তো সবকিছুরই অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে- অসুস্থতা, প্রকৃতির আক্রোশ, মারপিট, মৃত্যু। আপনার জন্য আর কোন দুর্যোগ বাকি আছে বলে মনে হয়?
গিলিয়াম : এখানেই সমস্যা। হিথের মৃত্যুর মতো বড় সমস্যা আর হওয়ার নয়। এটা ছিল খুবই উদ্ভট কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ একটা ঘটনা। একইসাথে এই বিষয়টা বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতাও আমার জীবনে এনে দিয়েছিল। জনি, কলিন আর জুড এসে পুরো কাজটা নামাল-পুরো ফাঁকা জিনিসের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করল। সব অর্থ হিথের মেয়ে পেয়েছে। পুরো বিষয়টাই ছিল ব্যতিক্রম।
প্রশ্ন : আপনাকে কেউ এভাবে বলেছে যে তারা আপনার কাজ অনেক পছন্দ করে কিন্তু ভয়ের চোটে আপনার সাথে কাজ করতে পারে না- কারণ গণ্ডগোলের ভয়টা অনেক বেশি?
গিলিয়াম : না, এমনটা হয় না। এমন একজনই ছিল, এরিক আইডল। এরিক সরাসরি বলে দিয়েছিল যে সে আমার সাথে কাজ করতে চায় না। হিথের মৃত্যুর পর তাঁর নিজের এই সিদ্ধান্তের ওপর আস্থা আসবার কথা! ‘এটা পরিষ্কার যে নির্ঘাত কিছু গণ্ডগোল আছে। সে নেহাত ছবিগুলো বানায়, পুরো বিষয়টাই হয় খুব অস্বস্তিকর আর এগুলো সামলানোর জন্য আমি অনেক বেশি বুড়ো একটা মানুষ!’ এরিক সবসময়ই খুব রসিক একটা মানুষ। এভাবেই কথা বলত সে। তবে আমি নিজের সাফাই গাইতে চাই না, আপনার অবশ্যই অভিনেতাদের জিজ্ঞেস করা উচিত। ওদের জিজ্ঞেস করুন, দেখুন ওরা কি বলে।
প্রশ্ন : আপনার কিছু ছবি কেবল প্রযোজকদেরই গণ্ডগোলে নয়, বরং দর্শকদেরও মাথায় তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। দেখা গেছে তাদের অনেকেই আপনার ছবি দেখবার পর অনেকটা সময় পর্যন্ত চিন্তাভাবনাও করতে পারেনি ঠিকমতো। আপনার ছবি ‘দ্য ফিশার কিং’ নিয়ে গল্প আছে একটা। নিউইয়র্কের শো চলবার সময় এক নারী...
গিলিয়াম : হ্যাঁ। সে সিনেমা হল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে বিশ ব্লক হেঁটে বাড়ি গেল, আমি বাড়ি যাওয়ার পর বুঝতে পারল যে সে আসলে বাড়ি আসেনি, সে পুরো ভুল রাস্তায় এসেছে। সোজা কথায় সে হারিয়ে গিয়েছিল। ‘ব্রাজিল’ ছবিটা দেখে আরো ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল একজনের। সে লোক পেশায় ছিল আইনজীবী। ছবিটা দেখে তার মাথায় এমনই তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল যে সে হল থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের অফিসে চলে যায়, আর অফিসে নিজের রুমে ঢুকে দিব্যি তিন দিন ধরে নিজেকে তালা মেরে রাখে! ইউনিভার্সালের এক নারী কর্মকর্তা ‘ব্রাজিল’ ছবির প্রচারণায় কাজ করছিলেন। আমায় তিনি বলেছিলেন যে, তিনি ছবিটা দেখেছিলেন। দেখে তার মনে হয়েছিল ছবিটা দারুণ! এরপর তিনি বাসায় যান, ডিনারের জন্য তৈরি হন, খাবারদাবার তৈরি করেন, খাওয়াদাওয়া করেন, ঘুমোবার জন্য প্রস্তুতি নেন এবং ঘুমোবার আগে গোসল করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সব ঠিক, বাথরুমে গিয়েই গোলযোগ বাঁধে। শাওয়ারের নিচে গিয়েই তিনি ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দেন, তারপর একটানা কাঁদতেই থাকেন। সে কান্নাকাটির আর থামাথামি নেই!
প্রশ্ন : এই গল্পোগুলো শুনে কি আপনার ‘দারুণ তো’ ধরনের কিছু মনে হয় কখনো?
গিলিয়াম : আলবত! আমি কাউকে প্রভাবিত করতে পেরেছি, তাদের জীবনে একটা ঝাঁকি দিয়েছি- তাদের মধ্যে একধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে; ছবিগুলোও আসলে এমন বিষয় নিয়েই গড়ে ওঠা। চলচ্চিত্র আমার জীবনের ভোলই পাল্টে দিয়েছে। দুনিয়ার ওপর আামার যেমন ধারণা, তা একদম বদলে গেছে চলচ্চিত্রের কারণেই। চলচ্চিত্র আমাকে প্রতিনিয়ত বদলেছে, একেকবার আমি ছবি দেখেছি আর একদম আউলে গেছি বলতে পারেন। তবে হ্যাঁ, সাধারণ কোনো ছবি দেখে, মানে ডোরিস ডে বা রক হাডসনের ছবি দেখে নয়- একদম সত্যিকারের ছবি দেখে। এগুলো আমার জীবন বদলে দিয়েছে, আর আমি কেবল সে ধারাটা বয়ে নিতে চেয়েছি।