গপ্পো তক্ক যুক্তি
জানি না কেন এসব ছবি করি : ড্যারেন অ্যারোনফস্কি
মার্কিন চলচ্চিত্রকার ড্যারেন অ্যারোনফস্কি তাঁর সব ছবির জন্যই আলোচিত, সমালোচিত এবং বিখ্যাত। যেকোনো ‘অ্যারোনফস্কি ফিল্ম’ কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং ভয়ংকর এক সাইকাডেলিক যাত্রা বললে ভুল হয় না। কেন তাঁর ছবি এত ‘কঠিন’ হয়ে ওঠে, তা নাকি নিজেও ঠিক জানেন না ১৯৬৯ সালে ব্রুকলিনে জন্মানো এই ভাবুক মানুষটি। অ্যারোনফস্কির ‘পাই’, ‘রিক্যুইম ফর আ ড্রিম’, ‘দ্য ফাউন্টেন’, ‘দ্য রেসলার’, ‘ব্ল্যাক সোয়ান’- প্রতিটি ছবিই একেকটি মাস্টারপিস। এই সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করা হয়েছে ‘দ্য টকস’ থেকে।
প্রশ্ন : মিস্টার অ্যারোনফস্কি, আপনি কি আপনার দর্শকদের যন্ত্রণা দিয়ে মজা পান?
অ্যারোনফস্কি : আসলে যন্ত্রণার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক মাত্রায় যাচাই হয়। অনেকে যন্ত্রণা দিব্যি উপভোগ করে। সুতরাং, তাদের জন্য বিষয়টা ঠিকঠাক আছে। আমি যতটা পারি তত চেষ্টা করে যাই আর কি। আমার কাছে ব্যাপারটা এখনো এ রকম যে আমি যেন এখনো আমার বোনের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাকে জ্বালাতন করছি! আসলে আজকের দুনিয়াই এমন যে মানুষ লম্বা সময় মনে রাখবে-এমন কোনো চিন্তা বা ইমেজ তৈরি করা খুব কঠিন। কাজেই সে রকম কিছু করতে চাইলে পুরো কাজটাই হতে হবে একদম কড়া, তীব্র।
প্রশ্ন : আপনার ছবিতে ফলাফল নির্ধারিত হয় না সাধারণত। ব্যাপারটা কি ইচ্ছাকৃত?
অ্যারোনফস্কি : (হেসে) সত্যি করে বলতে গেলে, আমি কখনোই এমন চাই না। আমি চাই লোকজন কাজটাকে ভালোবাসুক আর খতিয়ে দেখুক, এই আর কি! আমার কাজ এমনই। আমি এভাবেই কাজ করি, আর এর কোনো বিকল্পও আমার জানা নেই। ‘রিক্যুইম ফর আ ড্রিম’ দেখে অনেকে আমাকে বলেছিল যে আমি নাকি তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছি! অনেকে ধপাধপ পড়েও গিয়েছিল। টরন্টোতে যখন আমরা ছবিটা দেখাই, তখন সেখানে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসতে হলো, কারণ সেখানকার একজনের বুক একদম ধড়ফড়িয়ে উঠেছিল! এখন অবশ্য সময় বদলেছে, তবে তখনকার সময়ে একটু অন্যরকম তো ছিলই। ‘পাই’-এর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছিল। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এটাকে বলেছিল ‘কর্কশ, একরোখা আর বিবর্ণ’ আর এই ছবির মিউজিক তাদের মতে ছিল ‘কাঁপুনি তোলা’! এমন অবস্থায় আপনি কী করবেন? আসলে আপনি কিন্তু সবই জয় করতে পারবেন না।
প্রশ্ন : কিন্তু এখন তো হালচাল অন্যরকম দেখা যায়! আপনার শেষ দুটো ছবি দর্শক খুব সুন্দরভাবে নিয়েছে।
অ্যারোনফস্কি : আমার ধারণা যে ‘দ্য রেসলার’ মানুষজনের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। সবাই বলছিল, ‘তুমি কেন রেসলিং নিয়ে ছবি করছো, তাও আবার মিকি রুর্কিকে নিয়ে? এসব কী করছো তুমি? তুমি কি একেবারে ক্যারিয়ারের লালবাতি জ্বালাতে চাও?’ এমন সময়ই দেখলাম যে ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বেশ ভালো করল। আমার মনে হলো যে স্বাদ একটু বদলেছে বটে! আপনি জানেন, যখন আমরা ‘রিক্যুইম ফর আ ড্রিম’ বানালাম, সেটা থিয়েটারে দেখিয়ে আমরা সব মিলিয়ে আয় করেছিলাম মোটে তিন মিলিয়ন ডলার। আমার ধারণা যে সময়টা যদি এখনকার হতো, তাহলে এ গল্প হতে পারত অন্যরকম। নিশ্চয়ই এটা বেচাবিক্রির আরো বেশ কিছু পথ বের করে ফেলত তারা। এই ছবিটা যে ‘বয়’জ ডোন্ট ক্রাই’-এর আগে তা তো জানেনই। এরপরের ছবিগুলো কেন যেন হঠাৎ করেই ‘অস্কারের ছবি’ হয়ে যেতে লাগল! তাই আমার মনে হয়, মুভি থিয়েটারে দর্শকরা যেমন স্বাদ চায়, তা হয়তো বা বেশ বদলেছে। হাততালি পাওয়ার মতো কোনো কাজ করার জন্য আমার হাতে আর বেশি সময় নেই, বুড়িয়ে যাব শিগগিরই। কাজেই এখন চটজলদি শেষ সময়ে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : এখনো কি কোন কমেডি ছবি পরিচালনা বা লেখার কথা চিন্তা করতে পারেন?
অ্যারোনফস্কি : ছাত্রাবস্থায় আমার করা ছবিগুলোর অনেকগুলো ছিল কমেডি, কাজেই করতে তো ভালো লাগার কথা! কিন্তু এ ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই...কিছু কারণে আমি এই অন্ধকার, বিভ্রান্তিতে ভরা ছবিগুলো করে যাই... জানি না কেন এসব ছবি করি!
প্রশ্ন : ব্যাপারটা কি ইনট্যুইশন?
অ্যারোনফস্কি : বলতে পারেন। ব্যাপারটা এ রকম যে- কোনো গল্পের মধ্যে কিছু একটা আছে যার সাথে আমি কানেক্ট করতে পারি, আর সেটাই আমাকে ওই ওজনদার জিনিসটাকে বয়ে নেওয়ার প্রেরণা জোগায়। আপনি জানেন যে আমার প্রোজেক্টগুলো সব ম্যারাথন দৌড়ের মতন। এর অনেকগুলোই আসলে শেষ হওয়ার কথা ছিল না- কিন্তু শেষমেশ শেষ হয়েছে বটে! কারণ একটাই-আমি বারবার পেছন ফিরে ওগুলোকে নাড়াচাড়া করেছি, লালন করেছি। সব সময়ই আমি সমস্ত কিছুর মানে খুঁজে বের করতে চেয়েছি।
প্রশ্ন : বটে! এটা অবশ্য দ্য ফাউন্টেন থেকেও আঁচ করা যায়। প্রোডাকশনের কাজ চলার সময় আপনি ব্র্যাড পিটকে হারিয়েছেন, তবুও আপনি কাজটা শেষ করে ছেড়েছেন। সেই তো ওটার মূল অভিনেতা ছিল!
অ্যারোনফস্কি : পাক্কা ১৮ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে, এমন সময় সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। পুরো ছবিই ভেস্তে গেল। এরপর ছয়-সাত মাস আমি শুধু ভেবেছি যে কী করা যায়, কী করা যায়! এক রাতে আমি কোনোমতেই ঘুমুতে পারছিলাম না, তারপর উঠে বসলাম। আমি আমার অফিসে, চোখ মেলে চারপাশ দেখলাম। থরে থরে বিস্তর বই ছিটিয়ে রয়েছে যেগুলো আমি দ্য ফাউন্টেন এর জন্য রিসার্চ করার সময় পড়েছি। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে পুরো জিনিসটা আমার রক্তকণায় মিশে আছে। সাথে এও বুঝলাম, এই কাজ শেষ না করার আগ পর্যন্ত কখনোই আমি এর থেকে মুক্তি পাব না। যদিও বা উল্টোদিকে ১৮ মিলিয়ন ডলারের বোঝা, তবুও...কাজটা আমার করা ছাড়া উপায় ছিল না।
প্রশ্ন : কীভাবে যে কাজটা শেষ করলেন ভাবতেই পারি না...
অ্যারোনফস্কি : পুরো ব্যাপারটাই ছিল হতাশাজনক। এই ছয়-সাত মাস আমার এক অন্ধকার সময়। বিশেষ করে আমার খুবই খারাপ লাগে সব ক্রু আর স্টাফদের জন্য। এই ঘটনা তাদের জীবনে খুবই বাজে প্রভাব ফেলেছিল। অনেকে এমনকি শহর ছেড়েও চলে গেছে...
প্রশ্ন : কেন চলে গিয়েছিলেন ব্র্যাড পিট?
অ্যারোনফস্কি : আসলে এটা নিয়ে কথা বলা খুবই কঠিন। আমরা প্রায় আড়াই বছর একসাথে কাজ করেছি, কাজেই আমাদের মধ্যে খুব সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ব্র্যাড এভাবেও বলেছে যে এ কাজটা ছেড়ে যাওয়ার সময় তার মনে হয়েছে সে যেন তার প্রেমিকার সাথে সম্পর্কের ইতি টানল! কিন্তু যাই হোক, একটা বিষয়ের জন্য তো আর সম্পর্ক ভেঙে যায় না! আমার মনে হয় যে, আমি যখন ছবির প্রি-প্রোডাকশনের জন্য ছয় মাস বাইরে ছিলাম, তখন থেকেই আসলে সমস্যা পাকিয়ে উঠেছিল। পিট ওই সময়টায় এলএতে (লস অ্যাঞ্জেলেস) ছিল। আমি বলব যে, সম্ভবত এ সময়টাতেই আমাদের ক্রিয়েটিভ দৃষ্টিভঙ্গিটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল, ব্যস!
প্রশ্ন : আপনি যখন সেটে থাকেন, তখনো কি ইনট্যুইশনটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?
অ্যারোনফস্কি : আরে, আপনি যখন সেটে থাকবেন তখন তো পুরো কাজটাই আপনার ইনট্যুইশনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে! এটা পুরো সময়ের জন্যই হতে থাকবে। কিছু ফিল্মমেকারদের নিয়ে এমন উড়োগপ্প আছে যে তারা নাকি যেমন চায় বা যেমন করে ভাবে, ঠিক তেমনই ছবি বানায়। যা হোক, হয়তো বা কিছু নির্মাতার ক্ষেত্রে এ কথা খাটতে পারে, তবে আমি একেবারেই ওভাবে কাজ করি না।
প্রশ্ন : তো আপনি কাজটা করেন কীভাবে?
অ্যারোনফস্কি : আমি যতটা সম্ভব দক্ষ মানুষজন, সেরা উপকরণাদি সেটে হাজির করার চেষ্টা করি। আমার চেষ্টা থাকে এমন আবহাওয়া তৈরি করা, যাতে শিল্পীরা কিছু করার জন্য ঠিকমতো চেষ্টা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভুলও হতে পারে, তবে তাতে আপত্তি নেই। এর থেকেই আমি আমার ইনট্যুইশনকে অনুসরণ করতে থাকি আর সঠিক জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করি। আমার মনে হয় যে কোনো একটা বিষয় সেরা বানানোর জন্য যদি অতিরিক্ত চাপাচাপি করতে থাকেন, তাহলে ওটা নেহাতই দম ফুরিয়ে চ্যাপ্টামতন একটা কিছুতে পরিণত হবে। সেটা হবে নিষ্প্রাণ, একদমই কৃত্রিম কিছু।
প্রশ্ন : এতকিছুর পরেও মনে হয় একটা ভালো টিম তৈরি করা আপনার জন্য বেশ সহজ!
অ্যারোনফস্কি : ঠিক তা না...আমার ইচ্ছে হয় যে আমি যদি আরো ম্যানিপুলেটিভ হতাম, মানে আমার যদি আরো প্রভাব তৈরি করার ক্ষমতা থাকত! তবে আমি ও রকম নই। আমি বরং শিল্পীদের সাথে অনেক সৎ আর খোলামেলা। আমি তাদেরকে এভাবে বলি, ‘দেখুন, এই কাজটা করার জন্য এই পরিণতি হবে। কাজটা এমনই যন্ত্রণাদায়ক। আর কাজটা আপনাকে করতেই হবে।’ এরপর তাদের অনেকেই বলেন, ‘উম, আমি আসলে কাজটা করতে চাচ্ছি না!’ কেবলমাত্র এ কারণেই আমি অনেক শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের হারিয়েছি। মানুষের জীবন ঝামেলায় ভরে ওঠে, অন্যদিকে মানুষজনের রীতিমতো কত কত সুযোগ আছে! আমি বলতে চাচ্ছি যে আমি আসলে যাদের নিয়ে কাজ করেছি তাদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন! তাদের কয়জনই বা খুব চূড়ান্ত রকম উঁচুদরের? আর আমি যদি আসলেই অমন লোকজনদের পেতাম, তাহলে হয়তো তারা ভিন্ন রকম কিছু একটা করার সুযোগ পেত! কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি আসলে তাদেরকে পাইনি।