গপ্পো তক্ক যুক্তি
এখন সব খুনোখুনি ডিজিটালি করা হয় : ব্রায়ান ডি পালমা
(ব্রায়ান ডি পালমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ‘স্কারফেস’ই যথেষ্ট। পুরো নাম ব্রায়ান রাসেল ডি পালমা। ১৯৪০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে জন্ম তাঁর। পড়ালেখা করেছেন পদার্থবিদ্যায়, কিন্তু হাত পাকিয়েছিলেন সিনেমা বানিয়েই। হলিউডের ইতিহাসে স্মরণীয় এবং শ্রেষ্ঠত্বের এক স্থান এই গুণী পরিচালকের। ছবি পরিচালনা করেছেন ৩৮টি। ‘স্কারফেস’ ছাড়াও ‘মিশন ইম্পসিবল’, ‘দি আনটাচেবলস’, ‘ক্যারি’, ‘কার্লিতো’স ওয়ে’, ‘ব্লো আউট’, ‘ড্রেসড টু কিল’, ‘বডি ডাবল’ তাঁর বিখ্যাত ছবি। সাক্ষাৎকারটি ‘দ্য টকস’ থেকে ভাবানুবাদ করা হয়েছে।)
প্রশ্ন : ব্রায়ান ডি পালমা, সিনেমায় সহিংসতা বিষয়টি কি সুন্দর হতে পারে?
উত্তর : নিশ্চয়ই! সিনেমায় যে সহিংসতা বিষয়টি দর্শনীয় হতে পারে, তা তো স্যাম পেকিনপাহ দারুণ দেখিয়েছেন। ড্রামা ঘরানার সিনেমায় এটি ভিত্তিপ্রস্তরের মতো বলতে পারেন। এটা (ভায়োলেন্স) চরমভাবে কার্যকর, আবেগী এবং চরম নাটকীয় হতে পারে।
প্রশ্ন : আপনার শুট করা খুনের দৃশ্যের মধ্যে কোনটিকে সবচেয়ে সেরা মানেন?
উত্তর : ‘ড্রেসড টু কিল’-এর কথাই মনে হচ্ছে বলতে হবে। ওই যে এলিভেটরে খুন করার দৃশ্যটা। পুরো বিষয়টি নিয়ে দারুণ পরিকল্পনা আঁটা ছিল আমার মাথায়। ববি অ্যানজিকে খুন করছে, অন্যদিকে ন্যান্সি পুরো ঘটনা দেখে ফেলছে; সে সঙ্গে আয়নায় পুরো দৃশ্যটা—আর স্লো মোশনের খেলা! আমার মনে হয়, এটাই আমার করা সবচেয়ে ভয়াবহ খুনোখুনি!
প্রশ্ন : কোনো নারীকে খুন করা হচ্ছে, এটা কি দর্শকের হজম করা বেশি কষ্টকর?
উত্তর : এসব ক্ষেত্রে আমি আসলে পুরুষের চেয়ে নারীকেই বেছে নেব বরং!
প্রশ্ন : কেন বলতে পারেন?
উত্তর : আদিযুগের হরর ছবিগুলোর দিকে তাকালে ব্যাপারটা ধরতে পারবেন। যেগুলোয় ফিনফিনে নেগলিজি (নারীদের এক ধরনের রাত্রিবাস) পরা মেয়েরা ভুতুড়ে বাড়িতে মোমদানি হাতে হাঁটত। তাদের খুবই ইন্টারেস্টিং, সে সঙ্গে ভঙ্গুর দেখায়। উল্টোদিকে আপনি কল্পনা করুন যে আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার মোমদানি নিয়ে হাঁটছে। আপনার কি কোনো অবস্থায় মনে হবে যে, কোনো বিপদ বা ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে? ব্যাপারটা এ রকমই!
প্রশ্ন : এই যে ৪০ বছরেরও লম্বা সময় ধরে কাজ করছেন, এর মধ্যে খুনের দৃশ্য চিত্রায়ণে কোন ধরনের পরিবর্তন এসেছে?
উত্তর : এখন সব খুনোখুনি ডিজিটালি করা হয়!
প্রশ্ন : পুরোনো দিনগুলো কি মিস করেন না, যখন আলগা কাঠামো আর প্রচুর নকল রক্ত দিয়ে এসব খুনোখুনির শটগুলো নিতেন?
উত্তর : একদম না। এটা একেবারে একঘেয়ে আর বিরক্তিকর একটা বিষয়। একবার কোনো একটা শট না মিললে পুরোটা আবার সাজিয়ে করতে প্রচুর সময় খরচ হয়ে যেত। ‘দ্য ফিউরি’র শেষদিককার কথা বলি। জন কাসাভেটসকে তখন জ্বালিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পালা। সে যাই হোক, তাকে উড়িয়ে দেওয়া কাজ, তাকে একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেওয়া হলো। সেও দিব্যি বিস্ফোরিত হয়ে গেল, কিন্তু কাজের কাজ হলো না। আমার আট-নয়টি হাইস্পিড ক্যামেরা ছিল; কিন্তু প্রথমবারের মতো যেটা এলো, সেটা কাজ চালানোর মতো হলো না। শরীরের যে যে টুকরোগুলো যে ক্যামেরার ‘ক্যাচ’ করার কথা ছিল, ঠিক সেভাবে হয়নি। সেটের কথা কী আর বলব, পুরোটা সেট রক্তে মেখে সয়লাব! আবারও এই শট নেওয়ার জন্য সব ঠিকঠাক করতে আমাদের পুরো একটা সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : বলেন কী! তা সেকেন্ড টেকে কাজ হয়েছিল তো?
উত্তর : হ্যাঁ, সেকেন্ড টেকটা মোটামুটি ভালোই কাজ চালানোর মতো হয়েছিল। এ কাজ আগে কেউই করেনি। আমার ক্যামেরাগুলো ছিল অবিশ্বাস্য রকম দ্রুতগতিসম্পন্ন, সাধারণত এ ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করত জ্যোতির্বিদরা। তাও পুরো বিষয়টি এমনই জটিল ছিল যে এর মধ্যেও তিনটে ক্যামেরা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। সবকটা ক্যামেরা চরম রকম সুপার স্লো মোশনে শট নিচ্ছিল! আপনার বুঝতে হবে যে, এটা সত্তরের দশকের কথা! টেক খতম হওয়ার পর সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল আর কী (হাসি)!
প্রশ্ন : ভিন্ন কোনো রেটিংয়ের জন্য আপনি কখনো কি কোনো সহিংস দৃশ্য বাদ দিয়েছেন?
উত্তর : সত্তর আর আশির দশকে আমায় এ নিয়ে দারুণভাবে লড়াই করতে হয়েছে, এমনকি ষাটের দশকেও! ১৯৬৮ সালে রেটিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পর আমার প্রথম দুটি ছবি ‘এক্স’ রেটিং পেয়েছিল। সেই থেকে এগুলো নিয়ে আমার লড়াই করতে হয়েছে ‘স্কারফেস’ পর্যন্ত, এমনকি তার পরও।
প্রশ্ন : ‘স্কারফেস’ও কি প্রথমে ‘এক্স’ রেটেড হয়েছিল?
উত্তর : তা হয়েছিল বটে! তবে বোর্ডকে রেটিং বদলানোর ব্যাপারটা বোঝাতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম। তারা এটাকে ‘এক্স’ রেট দেওয়ার পরও আমি পুরো কমিটির কাছে এটা নিয়ে আপিল করতে পেরেছিলাম, তার পর সফলও হয়েছিলাম। ‘স্কারফেস’-এর এডিটিং কীভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে তর্ক আছে বিস্তর, তবে বাস্তবটা একেবারেই আলাদা। আমি রেটিং কমিটিকে বোঝানোর জন্য যা যা বাদ দিয়েছিলাম, সেগুলো আবার ঠিকঠাক জায়গামতো জুড়ে দিয়েছিলাম। সুতরাং আপনারা যা দেখেছেন, সেটাই আদি ও অকৃত্রিম ‘স্কারফেস’!
প্রশ্ন : এখনো ‘স্কারফেস’-এর এহেন প্রভাব-প্রতিপত্তি কি আপনার মুখে হাসি ফোটায়?
উত্তর : তা ফোটে বৈকি। তবে এটা আসলে নিয়তি, কর্মফল বা এমন কিছু, যা আমি ঠিক জানি না। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। আপনার বানানো ছবিটা সময় ছাড়ানো, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা সময় ছাড়িয়ে এগিয়েই চলেছে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে এমন কিছু আছে, যেটা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে একটা সূত্রে গেঁথেছে। আমি বোধ করি, স্কারফেস আসলে গ্যাংস্টার বয়ানের আদলে এক খাঁটি মার্কিনি স্বপ্নবাজির গল্প।
প্রশ্ন : র্যাপ মিউজিকেও তো এটি একটি বড়সড় থিম! একেই কি আপনি হিপহপ কমিউনিটির ছবিটির প্রতি এমন আচ্ছন্নতার কারণ মানেন?
উত্তর : অধিকাংশ অভিবাসীর কপালেই একটি কাজ বা পড়ালেখার বদলে দুর্ভোগটা জোটে, জানেনই তো ব্যাপারটা। কাজেই আপনি কী করবেন? মানে মানে অবৈধ জিনিসপাতি লেনদেন শুরু করে দেবেন, চোখের নিমেষে বড়লোক বনে যাবেন, চরম ক্ষমতা পেয়ে যাবেন; আর সে সঙ্গে হয়ে উঠবেন উন্মাদ—প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে। এ ছবিতে কিছু র্যাপার পুরো ময়দানটাই পেয়েছেন নিজেদের মতো করে...
প্রশ্ন : এর ব্যাখ্যা আপনি কীভাবে দেবেন?
উত্তর : এটা আসলে সংস্কৃতির একটা অংশে ঢুকে গেছে, এটাই সবাইকে অবাক করে দেয়। আমার জমানার লোকজন ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’-এর ডায়ালগ আওড়াত। এখন তাদের মুখ ফুটে বেরোয় ‘স্কারফেস’-এর লাইন। ব্র্যান্ডোর ‘আই কুড হ্যাভ বিন আ কন্টেনডার’ ডায়ালগের বদলে এখন ‘ডোন্ট গেট হাই অন ইয়োর ওউন সাপ্লাই’ কিংবা ‘ফার্স্ট ইউ গেট দ্য মানি, দেন ইউ গেট দ্য পাওয়ার, দেন ইউ গেট দ্য উইমেন’ ডায়ালগগুলো এখন বেশি চালু আর চোস্ত শোনায়।
প্রশ্ন : কোনো র্যাপ শিল্পী কি কখনো আপনাকে একসঙ্গে কাজ করার জন্য সেধেছে?
উত্তর : আসলে যা ঘটেছে তা হলো ইউনিভার্সাল। ‘স্কারফেস’-এ একটা র্যাপ জুড়ে দিয়ে পুনর্বার মুক্তি দেওয়ার জন্য বহু পীড়াপীড়ি করেছে, আর আমি তাদের মোটেও অনুমতি দিইনি।
প্রশ্ন : তাই! গিওর্গিও মরোডারের স্কোরটাই (গান) তো অনেক!
উত্তর : ধন্যবাদ। আমারও একই ধারণা। কাজেই ওরা আমার ওপর একেবারে খাপ্পা, কারণ আমার অনুমতি মিললে ওরা অবশ্যই নির্ঘাত নতুন করে প্রচুর পয়সা কামাতে পারত। কিন্তু আমার কথা একটাই, ‘স্কোরটা বদলানোর নয়’!
প্রশ্ন : তা আপনি কি ফাইনাল কাট (চলচ্চিত্র সম্পাদনায় ব্যবহৃত একটি সফটওয়্যার) ব্যবহার করেছেন?
উত্তর : নিশ্চয়ই!
প্রশ্ন : পরিচালক হিসেবে আপনার লক্ষ্য পূরণে ফাইনাল কাট কি জরুরি?
উত্তর : এ যুগে আমরা সৌভাগ্যবান বৈকি! আমাদের ফাইনাল কাট আছে। আমরা ডিরেক্টর সুপারস্টার যুগের মানুষ। এখন খুব কম পরিচালকই ফাইনাল কাট ব্যবহার করে। স্করসেসি আর স্পিলবার্গ তো অবশ্যই করে, কিন্তু অমন লোক আর কজনই বা আছে! নতুনরা ফাইনাল কাটে ওস্তাদ নয় বলে স্টুডিওতে গিয়ে তাদের পুরোদমে লড়তে হয়। স্টুডিও যদি আপনার পুরো মুভির ভোল পাল্টে ফেলে তখন কী করবেন? আপনি একটা ছবি নিয়ে আর কত ঝগড়াঝাঁটি করবেন?
প্রশ্ন : ফাইনাল কাট সব সময়ই ছিল আপনার?
উত্তর : সব সময়ই! কেবল ‘গেট টু নো ইয়োর র্যাবিট’ বাদে। (হাসি)
প্রশ্ন : কেন কেন? ওখানে কী হয়েছিল?
উত্তর : আমাকে তো কাজ থেকেই ভাগিয়ে দিয়েছিল!