‘ওয়েল্ডিংয়ের ফুলকি থেকে হঠাৎ আমার ফোমের গুদামে আগুন লাগে’

‘টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় একটি দোকানে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছিলেন মজনু নামের এক মিস্ত্রি। ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করার সময় আগুনের ফুলকি গিয়ে আমার গুদামে রাখা ফোমের উপর পড়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম নিভে যাবে। পরে তা আরো বেড়ে যায়। আমি তখন নিচে নেমে আসি।’
এই কথাগুলো বলছিলেন রাশেদ রাসেল নামের এক ব্যবসায়ী। তাঁর রাজধানীর সুপার মার্কেটের নিচতলায় একটি ফোমের দোকান আছে। আর দোতলায় আছে তাঁর ফোমের গুদাম। তিনি আজ বুধবার রাতে এনটিভি অনলাইনের কাছে এমনটাই দাবি করেছেন।
যদিও সন্ধ্যায় লাগা আগুন দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে প্রাথমিক ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আগুনে ১৪-১৫টি দোকানঘর পুড়েছে। তবে কোথায় থেকে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি।
আজ বুধবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে রাজধানীর ব্যস্ততম এই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এখানে দেড় হাজারের বেশি দোকান রয়েছে। ব্যবসায়ীরা দ্রুততার সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন। তারপর সেখান থেকে ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়। তিন ধাপে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট ঘটনাস্থেলে এসে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস।
আগুন নিয়ন্ত্রণের আসার পর মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজেদের দোকানের অবস্থা দেখতে ভিতরে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে ফোমের দোকানদার রাশেদ রাসেলও ছিলেন।
রাত ৮টার দিকে রাশেদ রাসেল বলেন, ‘মজনু নামের এক ওয়েলডিং মিস্ত্রি মার্কেটের দ্বিতীয় তলার একটি দোকানে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছিলেন। কাজ করতে করতে আমার ফোমের গোডাউনে আগুনের ফুলকি গিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায় গোডাউনে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আগুন নিভে যাবে। কিন্তু আগুন নিভেনি। আরো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।’
‘যখন দেখলাম আগুন আরো বেড়ে যাচ্ছে তখন ভয়ে গোডাউন ছেড়ে পালিয়েছি। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার গোডাউন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
কাঁদতে কাঁদতে রাশেদ রাসেল আরো দাবি করেন, ‘মার্কেটের নিচতলায় ইসলাম বেডিং নামে আমার একটি ফোমের দোকান আছে। ওই দোকানের সব মাল উপরে থাকে। মজনু এই মার্কেটে প্রায় সবার ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করে দেন। ওয়েল্ডিংয়ের আগুনের ফুলকি থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।’
রাত পৌনে ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থলে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের আরো বলেন, 'গত মাসের ১০ তারিখে এই মার্কেটটিতে অগ্নিনির্বাপণের মহড়া দেওয়া হয়। তখন এখানে বেশকিছু ঘাটতি পাওয়া যায়। মার্কেট কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে এসব ঘাটতি দূর করতে দুই মাস সময় চেয়েছিলেন। এর মধ্যেই আজকে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।'
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ৭টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেন্স) জিল্লুরুর রহমান ঘটনাস্থলে থাকা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে। তবে সম্পূর্ণ আগুন নির্বাপণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ করে যাব। ডাম্পিং চলছে। এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।’
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।
এর আগে ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কর্তব্যরত কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র মোদক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিকেল সোয়া ৫টার দিকে টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটে আগুনের সূত্রপাত হয়। জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯-এর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে আমাদের এখানে সংযোগ দেওয়া হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে যায়। আগুনের তীব্রতা বেশি থাকায় পরে আরো ১০টি ইউনিট এতে যোগ দেয়। সবশেষ সেখানে যায় আরো তিনটি ইউনিট। মোট ২৫টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।’
আজ সকাল থেকেই দোতলা এই মার্কেট খোলা ছিল। নিচতলা ও দোতলা মিলিয়ে ক্রেতাও ছিল প্রচুর। সন্ধ্যায় দিকে জমজমাট অবস্থায় হঠাৎ করেই দোতলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করে। তারা জানায়, দোতলায় ১৫-২০টির মতো দোকান ছাড়াও গুদাম রয়েছে। সেখানে বেডসিট, কাপড়, খেলনা ও প্লাস্টিকের দোকান রয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয়দের হাতে থাকা মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, আগুনের লেলিহান শিখা উপরের দিকে উঠছে। সন্ধ্যায় আকাশ ধূয়ায় কালো হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী বাইরে বেরিয়ে এসে কান্না ও চিৎকার শুরু করে। আগুন দেখে অনেক সাধারণ মানুষও সেখানে জড়ো হয়। খবর পেয়ে আশপাশের থানা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে হাজির হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ সুষ্ঠুভাবে কারার জন্য সাধারণ মানুষকে মার্কেটের কাছে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। মার্কেটের নিচতলার প্রধান গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে শুধু ব্যবসায়ী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ছাড়া আর কাউকে ভিড়তে দেওয়া হয়নি।
রাজধানী সুপার মার্কেট বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এখানে ছোটবড় কয়েক হাজার দোকান রয়েছে। এটি ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। একতলা পাকা ভবনের উপর টিনের দোতলা এই মার্কেটের চারপাশেই রাস্তা রয়েছে। ফলে মার্কেটের চতুর্দিকে আটটি প্রবেশ পথ রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে, মার্কেটের পূর্ব পাশে শার্ট-প্যান্টের দোকান, পশ্চিম পাশে খাবার, শাড়ি, হাড়ি-পাতিল, জুতার দোকান, উত্তর পাশে রয়েছে থান কাপড়ের দোকান আর দক্ষিণ পাশে জুয়েলারি ও কসমেটিকসের দোকান রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা আরো জানায়, এখানে দেশি পণ্যের পাশাপাশি থাইল্যান্ড, ভারত, জাপান, চায়না এবং পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত পণ্য সামগ্রীও পাওয়া যায়। বিদেশি পণ্যগুলোর মধ্যে কাপড়, স্যান্ডেল ও কসমেটিক্স সমাগ্রী রয়েছে।