কে হচ্ছেন সাভার আওয়ামী লীগের কাণ্ডারী?

ঢাকার সাভারের রাজনীতির মাঠ এখন সরগরম। আগামী তিন বছরের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত সাভার। প্রার্থীদের পক্ষে আর দলীয় নেতাদের বিশাল বিশাল ফেস্টুন আর ব্যানারে ভিন্ন সাজে সেজেছে সাভার। আগামীকাল ১৫ নভেম্বর সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন ঘিরে উৎসবের আমেজ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কে হচ্ছেন, তা এক প্রকার নিশ্চিত। তবে সভাপতি নিয়েই আপাতত বিভক্ত দুটি শিবির।
কে হচ্ছেন সভাপতি? বর্তমান সভাপতি হাসিনা দৌলা নাকি আশরাফ হোসেন চৌধুরী ওরফে মাসুদ চৌধুরী?
এই প্রশ্নই এখন জোর আলোচনায়। একদিকে প্রচারণা আরেক দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরস্পরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা- এসব নিয়েই পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তীব্র লড়াই।
রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে বেশ আগেই দলছুট দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার। বলা হয়, নবম জাতীয় সংসদের সাংসদ তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত আলী হায়দার পট পরিবর্তনের পর থেকেই নিজ দলে ছিলেন কোনঠাসা।
সম্প্রতি বর্ধিত সভা ডেকে আলী হায়দারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক ছাত্রনেতা ও সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের হাতে।
সেই থেকে রাজনীতির মাঠে সাধারণ সম্পাদক পদে রাজীবের বিপরীতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী বা দ্বিতীয় প্রার্থী না থাকায় মঞ্জুরুল আলম রাজীবই যে কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন – তা নিশ্চিত
সম্মেলনে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী বর্তমান সভাপতি হাসিনা দৌলার বিপরীতে এবার প্রার্থী ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী ও ঢাকা জেলা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ কবীর।
১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ মেয়াদে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফিরোজ কবির। সভাপতি ছিলেন মরহুম শামসুদ্দোহা খান মজলিশ। ফিরোজ কবির ১৯৮৫ সালে যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। হন সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দলটির যুগ্ম মহাসচিব। ১৯৯৬ সালে আবার ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে।
ফিরোজ কবির জানান, কাউন্সিলে ভোটাভুটি হলে ৯৯ ভাগ ভোটই পাবেন তিনি।
অন্যদিকে মাসুদ চৌধুরীও বলেছেন, কাউন্সিলের ভোটাভুটি হলে তিনি হবেন সভাপতি।
এদিকে হাসিনা দৌলা ও মাসুদ চৌধুরীর পক্ষে বিপক্ষে জোর প্রচারণায় বিভক্ত দলের নেতাকর্মীরা।
কাউন্সিলের তদারকির ভূমিকায় রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। তিনি জানান, দলের কাউন্সিলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সৎ, যোগ্য ও নিবেদিত প্রাণ নেতাদের নির্বাচন করবেন কাউন্সিলরা।
সম্মেলন ঘিরে গতকাল দলের বর্ধিত সভায় প্রতিমন্ত্রীসহ নেতাদের উপস্থিতিতে মাসুদ চৌধুরীর পক্ষে ‘দুর্নীতিবাজদের সাভারে চাই না, পার্টি অফিস বিক্রিকারীদের সাভারে চাই না’ বলে স্লোগান দেওয়া হয়।
প্রশ্ন উঠেছে,কাকে ঘিরে এই স্লোগান? কোনো রাখঢাক না করেই মাসুদ শিবিরের নেতাকর্মীদের দেখা গেছে হাসিনা দৌলার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে আগে আসা বিভিন্ন খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতে।
স্বয়ং মাসুদ চৌধুরীর স্ত্রী ইয়াসমিন চৌধুরী সুমি গত ৬ নভেম্বর হাসিনা দৌলাকে দুদকের নোটিশ ও ‘ভয়াবহ দুর্নীতির দায় প্রশাসক হাসিনা দৌলার’ শিরোনামে ২০১৫ সালে দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর শেয়ার করেন।
গৃহবধূ থেকে ব্যবসায়ী পরে রাজনীতিতে পা রাখেন জামালপুরের মেয়ে হাসিনা দৌলা। বিএনপির জামানায় সাভারে হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। সেই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পান ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসকের পদ। ২০০২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সাভার উপজেলার টানা দুই বারের সভাপতি তিনি।
তবে সমালোচিত হন জেলা পরিষদে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে শত কোটি টাকার অনিয়ম আর দুর্নীতির ঘটনায়। গণমাধ্যমে খবর আসে, তাঁর সময়ে ৭৭ ভাগ প্রকল্পের হদিস মেলেনি। অনিয়ম আর লুটপাট চলেছে ফ্রি স্টাইলে।
বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একপর্যায়ে হাসিনা দৌলাকে তলব করা হয় দুদকে। ‘আমি তো কোনো দুর্নীতি করিনি- দুদকে কেন যাব?’ এই অবস্থান থেকে তলবি নোটিশ প্রত্যাখ্যান করে দুদকে আর যাননি তিনি।
বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের মামলায় দুদক ঢাকা জেলা পরিষদের ছয় প্রকৌশলী ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন দিলেও কোনো মামলায় অভিযুক্ত হননি হাসিনা দৌলা।
তাঁর সাফ কথা, ‘দলের জন্য আমি কী ত্যাগ করেছি তা জননেত্রী শেখ হাসিনাই ভালো জানেন। দুর্নীতি করলে তো আর আমি মাটির ঘরে থাকতাম না।’ তৃতীয় বারের মতো সভাপতি পদে থাকার বিষয়েও আত্মপ্রত্যয়ী হাসিনা দৌলা।
সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী মাসুদ চৌধুরীর স্ত্রী সাভার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াসমিন চৌধুরী সুমি। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে স্বামীর পক্ষে পোস্ট দিয়ে জানান, ‘কাউন্সিলে হচ্ছে মাসুদ-রাজীব পরিষদ’। ১১ নভেম্বর তিনি ফেসবুকে পোস্ট দেন, ‘এনাম ভাইয়ের পরিষদ মাসুদ-রাজীব পরিষদ। সাভার আশুলিয়ার ভবিষ্যৎ। আলহামদুলিল্লাহ।’
তবে স্থানীয় সাংসদ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানান, এখানে কোনো প্যানেল নেই। এই ধরনের প্রচারণা বিভ্রান্তিকর।
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্ভার থাকা মঞ্জুরুল রাজীব বলেছেন, এসব পোস্টে তিনি প্রচণ্ডভাবে বিব্রত। তাঁর কোনো প্যানেল নেই। দলের সভাপতি বাছাইয়ে তাঁর অবস্থান নিরপেক্ষ।
যদিও সভাপতি পদপ্রত্যাশী হাসিনা দৌলা ও মাসুদ চৌধুরী একাধিকবার বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। তাঁদের পরস্পরের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ও স্পর্শকাতর অভিযোগে বিব্রত নেতাকর্মীরাও।
এই ডামাডোলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ফিরোজ কবির শিবিরের প্রচারণাও স্তিমিত হয়ে এসেছে।
বোঝাই যাচ্ছে, সভাপতি পদের জন্য একাকীই লড়াই করতে হচ্ছে মাসুদ চৌধুরীকে।
তবে দলের স্থানীয় নেতারা বলছেন, কোনো অঘটন না ঘটলে সভাপতি হিসেবে হাসিনা দৌলার তৃতীয় বারের মতো ফিরে আসার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে হাসিনা দৌলার বিষয়ে অনেকেরই রয়েছে ইতিবাচক মনোভাব।
সম্মেলন সফল করতে গঠন করা হয়েছে সাতটি উপকমিটি। এতে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে ৩৩৪ জন কাউন্সিলরের। প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ২১ জন করে কাউন্সিলরের তালিকা জমা পড়েছে উপজেলা কমিটির কাছে। ১২ ইউনিয়নে সবমিলিয়ে এই সংখ্যা ২৫২ জন। সম্মেলনের দিন উপজেলা কমিটি কাউন্সিলর হিসেবে কো-অপ্ট করতে পারবেন ১৫ জনকে। যারা হবেন মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। এ ছাড়া উপজেলা পূর্ণাঙ্গ কমিটির ৬৭ জন সদস্যও কাউন্সিলর হিসেবে থাকবেন। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩৩৪ জন।
সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে কেউ বা তাকিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। কেউ বা কাউন্সিলরদের ভোটে।
সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, ঢাকা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষাউপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এমপি, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজীর আহমেদ এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক মাহাবুবুর রহমান, ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সরকারি সফরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থান করায় তাঁর উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা।