ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় সাতজনকে হারাল হবিগঞ্জ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ এলাকায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৬ জনের মধ্যে সাতজনের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়। নিহতদের পরিবারে চলছে শোক। স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ।
নিহত সাতজন হলেন হবিগঞ্জ শহরতলীর বড় বহুলা গ্রামের আলমগীর আলমের ছেলে ইয়াছিন আরাফাত (১২), আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা ও জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), বানিয়াচং উপজেলার তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়ার আড়াই বছরের মেয়ে আদিবা আক্তার সোহা ওরফে ছোঁয়ামণি ও মদনমুরত গ্রামের আল-আমিন (৩০), চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা গ্রামের পশ্চিম তালুকদার বাড়ির ফটিক মিয়া তালুকদারের ছেলে রুবেল মিয়া তালুকদার (২০), মিরাশী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া (৩০) ও একই উপজেলার আহমদাবাদ গ্রামের পিয়ারা বেগম (৩২)। তাঁরা উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন।
দুর্ঘটনায় নিহত ইয়াছিন আরাফাতের বাবা আলমগীর আলম আহত হন। তিনি হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও বহুলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। তাঁর ছেলে ওই বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। সে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য ছিল। ইয়াছিন বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামে যাচ্ছিল সাগর ও দর্শনীয় স্থান দেখতে। ট্রেন দুর্ঘটনায় ছেলেকে হারিয়ে তার মা হাসিনা আক্তার বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন।
অনেক আগেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন নিহত আল-আমিন। কোনো ভাই-বোনও ছিল না তাঁর। বিয়ে করেছিলেন। সংসারে ছিল দুই মেয়ে, রনিহা (৬) ও নুছরা (৮)। ১৯ দিন আগে একটি ছেলে হয় তাঁর। সেই ছেলের নাম রেখে আর কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি আল-আমিন।
নিহত আল-আমিনের চাচা বানিয়াচংয়ের বড়ইউড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য কুতুব উদ্দিন জানান, আল-আমিন চট্টগ্রামে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। ১৯ দিন আগে তাঁর এক ছেলের জন্ম হয়। ছেলের নাম রাখতে তিনি সম্প্রতি বাড়িতে আসেন। একমাত্র ছেলের নাম রাখেন ইয়ামিন। ছেলের নাম রেখে চাচা মনু মিয়া ও ফুফাতো ভাই শামীমকে নিয়ে সোমবার রাতে উদয়ন ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু রেল দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। অপর দুজন মনু মিয়া ও শামীম গুরুতর আহত হন।
বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন চুনারুঘাটের উবাহাটা গ্রামের রুবেল মিয়া তালুকদার। তিনি ওই গ্রামের পশ্চিম তালুকদার বাড়ির ফটিক মিয়া তালুকদারের ছেলে। পড়তেন স্থানীয় শানখলা মাদ্রাসায়। কিন্তু কক্সবাজার আর যাওয়া হয়নি রুবেলের।
চুনারুঘাটের উবাহাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. রজব আলী জানান, রুবেলসহ একই এলাকার চার বন্ধু সোমবার দিবাগত রাতে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন থেকে উদয়ন এক্সপ্রেসে করে কক্সবাজারে বেড়ানোর উদ্দেশে রওনা হন। পথে কসবায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান রুবেল। বাকি চার বন্ধুর মধ্যে একজন গুরুতর আহত এবং বাকিরা অক্ষত রয়েছেন। তবে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে ছিল শিশুটির নিথর দেহ। ফুটফুটে সুন্দর শিশুটি। পায়ে নেইল পলিশ দেওয়া। পোশাক-আশাক পরিপাটি। শিশুটিকে একনজর দেখতে এসে অনেকেই চোখের পানি ছাড়েন। শিশুটির পাশে কেউ ছিল না। তার মা-বাবা ও ভাই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি।
শিশুটির নাম আদিবা আক্তার সোহা ওরফে ছোঁয়ামণি। বয়স আড়াই বছর। সে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বড়বাজারের তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়া ও নাজমা বেগমের মেয়ে। সোহেল, নাজমা ও তাদের আহত ছেলেকে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পরে হবিগঞ্জ এবং সেখান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
সোহেল মিয়া জানান, তিনি ও তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত বৃহস্পতিবার তাঁরা হবিগঞ্জের বাড়ি আসেন। কর্মস্থলে যেতে গতকাল সোমবার রাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তাঁরা সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রাম অভিমুখী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন। পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় তাঁর আড়াই বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে আদিবা আক্তার সোহা মারা যায়। আহত হন তিনি, তাঁর স্ত্রী ও সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলে নাছির। তাঁরা এখন ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
হবিগঞ্জ শহরের আনোয়ারপুর গ্রামের আবদুল আহাদ জানান, তাঁর চাচাতো ভাই আলী মোহাম্মদ ইউসুফ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী চিশতিয়া বেগম চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী ও দেড় বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে ইশা আক্তারকে বাড়িতে আনতে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
ট্রেন দুর্ঘটনায় জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফের নিহত হওয়া প্রসঙ্গে কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুবেল আহমেদ চৌধুরী জানান, নিহত আলী মোহাম্মদ ইউসুফ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি চার ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয়। তাঁর বাবা মারা গেছেন ২০১১ সালে। আর বড় ভাই উসমান গনি ২০১৭ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ইউসুফই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।
চুনারুঘাট উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের সুজন মিয়া চাকরির ইন্টারভিউ দিতে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হয়েছেন। তিনি হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজের স্নাতকের ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি তিনি হবিগঞ্জ আদালতে মোহরার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ওই গ্রামের আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
চুনারুঘাটের আহমদাবাদ ইউনিয়নের ছয়শ্রী গ্রামের আবদুস সালামের স্ত্রী পিয়ারা বেগম সোমবার রাতে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। একাই তিনি বাড়ি থেকে রওনা হন। পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। তাঁর চার সন্তান রয়েছে। খবর পেয়ে সকালে তাঁর স্বামী আব্দুস সালাম লাশ আনতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান। এ বিষয়টি জানিয়েছেন আহমদাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত চৌধুরী।