লকডাউনে থমকে আছে বিচার, দ্রুত বিচারের আশা পরিবারের
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার এক বছর পূর্তি আজ ৩১ জুলাই। মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার ঘটনায় মামলা দায়েরের পর দ্রুত তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিলেও করোনায় থমকে গেছে বিচার কার্যক্রম। পরিবারের আশা—দ্রুত এ মামলার বিচার শেষে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খানের বড় বোন ও মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার এনটিভি অনলাইনকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘দ্রুত সময়ে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ায় বিচার নিয়ে আশাবাদী হয়েছি। কিন্তু, লকডাউনে মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এখন ভয় কাজ করে—৮৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া যাবে কি না। কারণ, সাক্ষীদের সব সময় পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তবু আমরা আশাবাদী—দ্রুত সময়ে সাক্ষ্য নিয়ে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ফরিদুল আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত ২৭ জুন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই একটানা তিন দিন বাদীসহ ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন নির্ধারণ করেন। কিন্তু, করোনার কারণে লকডাউনে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী নতুন দিন ধার্য করা হবে।’
মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান।
হত্যার পাঁচ দিনের মাথায় ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে, দুই নম্বর আসামি করা হয় ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে এবং তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে। এরপর মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। শুনানির পরে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে তাঁরা এখনও কারাগারে রয়েছেন।
মামলার তদন্ত ও অভিযোগপত্র
সিনহা হত্যা মামলার পর তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। তারা স্থানীয় তিনজন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। একজন আত্মসমর্পণ করে। এ ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে র্যাব। অভিযোগপত্রে ১৫ জনকে আসামি করা হয় এবং অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগপত্রে ৮৩ জনকে সাক্ষী করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।
কারাগারে থাকা অন্য ১৫ আসামি হলেন—বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী কনস্টেবল রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাগর দেব, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল সাগর দেব ও রুবেল শর্মা ছাড়া ১২ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ ছাড়া এ ঘটনার সময় মেজর সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা যে নীলিমা বিচ রিসোর্টে ছিলেন, সেখানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূরকে আটক করে। পরে তাহসিন রিফাত নূরকে অভিভাবকের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শিপ্রা দেবনাথকে রামু থানায় করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আর, সিফাতকে টেকনাফ থানায় করা হত্যা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার দুটি মামলা ও রামু থানায় করা মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। সিফাত, শিপ্রা ও তাহসিন বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। তাঁদের নিয়ে সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য কক্সবাজারে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কাজ করছিলেন।
পরবর্তীকালে, গত বছরের ৯ আগস্ট শিপ্রা ও ১০ আগস্ট সিফাতের জামিন মঞ্জুর করেন কক্সবাজারের আদালত। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। পরে ১৩ ডিসেম্বর এই দুই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) বিমান চন্দ্র কর্মকার রামু ও টেকনাফ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—পুলিশের করা দুই মাদক মামলায় শিপ্রার বিষয়ে অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
মামলার বর্তমান অবস্থা
চলতি বছরের ২৭ জুন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ মামলার অভিযোগ গঠন করার পর বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন। কিন্তু, করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ রোধে সরকারঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে হাইকোর্টের নির্দেশে সারা দেশের মতো কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তাই, চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত ২৭ জুন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই একটানা তিন দিন বাদীসহ ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন নির্ধারণ করেন। কিন্তু, করোনার কারণে লকডাউনে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না।
ফরিদুল আলম বলেন, এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী নতুন দিন ধার্য করা হবে।
এদিকে, জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) সন্তোষ বড়ুয়া এনটিভি অনলাইনকে জানান, লকডাউনের পরে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলে জেলা ও দায়রা জজ নতুন করে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ দেবেন। ওই তারিখে বাদীসহ সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করবেন আদালত।