সিনহা হত্যার রায় নিয়ে যা ঘটল সারা দিন
বহুল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত। আজ সোমবার কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল এ রায় ঘোষণা করেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যাঁদের
এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত (৩০), কনস্টেবল সাগর দেব, ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), স্থানীয় বাসিন্দা বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজকে (৪৫)। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের বিচারক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ছয়মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন।
খালাস পেলেন যে সাত জন
খালাস পেয়েছেন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান আলী (৪৭), কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০)।
রায় ঘোষণা নিয়ে অনিশ্চয়তা
আলোচিত এ রায় আজ সোমবার ঘোষণা করা হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল গতকাল রোববার। আদালতের কয়েকটি বিশ্বস্ত সূত্র রোববার বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে জানান, বিচারক এখনও রায় লিখে শেষ করতে পারেননি। রোববার মধ্য রাত পর্যন্ত রায় লিখবেন তিনি। রায় লেখা শেষ করতে পারলে তিনি সোমবার দিতে পারেন। তবে তা ফিফটি ফিফটি চান্স। হতেও পারে না-ও হতে পারে। রাতে ১২টা পর্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুমাতে যেতে হয়েছে। তবে সকাল ৮টার মধ্যে আদালতে গিয়ে পুলিশের নিরাপত্তা বলয় দেখে অনুমান করা গেছে রায় হতে পারে। সকাল দশটার পর জানা গেল, দুপুরের পর বিচারক রায় ঘোষণা করবেন।
দিনব্যাপী রায়ের অপেক্ষা
সোমবার সকাল দশটায় কক্সবাজার জেলা জজ আদালত থেকে বলা হয়, দুপুর দুটায় আসামিদের আদালতে হাজির করা হবে। তখন আদালতের পুলিশ প্রটেকশন কিছুটা ঢিলেঢালা হয়ে যায়। এ সময় সাংবাদিকরা কিছুটা সময় নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন।
প্রদীপের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
রায় ঘোষণা হবে দুপুরের পর, এ খবর শোনার পর দুপুর সাড়ে দশটার দিকে আদালত প্রাঙ্গণে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তাঁর সহযোগীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন করেন প্রদীপের হাতে নির্যাতিত ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ভুক্তভোগী দাবি করা লোকজন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সামনে টেকনাফের সাধারণ জনতা ও সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে এ মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
এ সময় টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তাঁর সহযোগীদের ফাঁসির দাবি জানান ভুক্তভোগীরা। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া লোকজনের মধ্যে কেউ জানান, তাঁরা ওসি প্রদীপের হাতে নিহতদের পরিবার; কেউ কেউ দাবি করেন, তাঁরা ক্রসফায়ার থেকে ফিরে আসা লোক কিংবা নির্যাতিত ব্যক্তি। তাঁরা সবাই ওসি প্রদীপের ফাঁসি চান।
এজলাসে প্রবেশে বাধা
রায়কে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে কঠোর নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। রায় শুনতে কক্সবাজার আদালতের শতাধিক আইনজীবী প্রবেশ করলে বিচারকক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এরপর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আদালতের এক কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়ে এনটিভি অনলাইনের এই প্রতিবেদক প্রবেশ করেন। স্থানীয় একজন ও ঢাকার দুইজন সাংবাদিক রায়ের সময় আদালতে প্রবেশ করতে পারেন।
আসামিদের হাজির
দুপুর দুটায় কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় সাবেক ওসি প্রদীপসহ ১৫ আসামিকে একে একে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাঁদের আদালতের কাঠগড়ায় রাখা হয়। প্রথমে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতকে কাঠগড়ায় ওঠানো হয়। পরে একে একে সকল আসামিকে আনা হয়।
রায়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আসামি ওসি প্রদীপ ও টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে কথা বলতে দেখা যায়। ওসি প্রদীপ জিন্স ও ছাই রঙের জাম্পার এবং লিয়াকত নীল রঙের জিন্স, সাদা-লাল রঙের টিশার্টসহ সাদা-কালো জ্যাকেট পরে ছিলেন।
রায়ের প্রথম দিকে বাকি ১৩ আসামিকে কাঠগড়ার উত্তর পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যদিও তখন সব আসামি নিরবে বসে থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষা করেন।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর রায় পড়া শুরু
আসামিদের আদালতে হাজিরের ২০ মিনিট পরে দুপুর দুটার দিকে আদালতে ওঠেন বিচারক। পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম মামলার কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেন। এরপর বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল প্রাথমিক কিছু কথা বলে রায় ঘোষণা শুরু করেন। দুপুর ২টা ২০ মিনিটে শুরু হয়ে রায় পড়া শেষ হয় সাড়ে চারটার দিকে। এ সময়ে আদালত কক্ষের পূর্বপাশে কাচ ঘেরা বিচারক বসেন। পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ রুমের মাঝখানে দুই সারিতে বিশটি বেঞ্চে আইনজীবীরা বসেন। তবে ডান পাশের প্রথম সারিতে মেজর সিনহার বোন ও স্বজনরা বসেন। তাদের সামনে পিপি বসেন।
অপরদিকে বাম পাশে লম্বা কাচ ঘেরা কাঠগড়ায় ১৫ আসামি অবস্থান করেন। পেছনের দিকে বিভিন্ন তদন্ত ও নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
রায় ঘোষণা
অনেক সময় অপেক্ষার পর বিচারক সাড়ে চারটার দিকে প্রধান দুই আসামির শাস্তি ঘোষণা করেন। তাতে প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর সাতজনকে খালাস ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ে তিন রকম প্রতিক্রিয়া
আদালতে রায় ঘোষণার সময় তিন ধরনের শাস্তি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তিন রকমের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আসামিরা। রায় শুনে কেউ কেউ উল্লাস প্রকাশ করেন আবার কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবার কেউ ছিলেন স্বাভাবিক।
বিকেল ৪টা ২০ মিনিটের দিকে প্রথমে প্রধান দুই আসামি কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন বিচারক। এ সময় ওসি প্রদীপ কাঠগড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে ছটফট করতে থাকেন। তবে অপর আসামি পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী ছিলেন স্বাভাবিক। তিনি দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে প্যান্টের পকেট দুই হাত ভরে চুপচাপ থাকেন। এ সময় আদালতের ভেতরে থাকা শতাধিক আইনজীবী রায়কে স্বাগত জানিয়ে চিৎকার করে ওঠেন।