আড়াই মাসে ঢুকেছে ৫০ হাজার, বছরে ফেরত ৬ হাজার

গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ আড়াই মাসে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-নির্যাতন-ধরপাকড়ের শিকার হয়ে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। অপরদিকে গত এক বছরে ছয় হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে অবৈধভাবে প্রবেশের পর পুশব্যাক করেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দাবি, ফেরত এই রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এদেশে কৌশলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। কিন্তু বিজিবির সতর্ক অবস্থানের কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অনেকটা প্রতিহত হয়।
আজ বুধবার টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবু জার আল জাহিদ জানান, টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্তে বিজিবি গত এক বছরে সীমান্ত, চেকপোস্টে ও নাফ নদ থেকে ছয় হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে প্রতিহত করে মানবিক সহযোগিতার মাধ্যমে মিয়ানমার ফেরত পাঠিয়েছে।
‘এর মধ্যে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ১৪২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৩১ জন, মার্চে ৩০৯ জন, এপ্রিলে ২০০ জন, মে ১১২ জন, জুনে ৭৪ জন, জুলাইয়ে ২০৭ জন, আগস্টে ৪০ জন, সেপ্টেম্বরে ১৯৫ জন, অক্টোবরে ১২৯ জন, নভেম্বরে দুই হাজার জন এবং ডিসেম্বরে দুই হাজার ৫০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়।’
গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এ হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য মারা যান। অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের ঘটনা ঘটে।
এর পরই মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর সেই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত হামলা চালাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে। এতে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। সেখানকার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দিচ্ছে, নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এমনকি অবিবাহিত নারীদের ধর্ষণের অভিযোগও করা হয়েছে এসব প্রতিবেদনে।
এর ফলে মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন ও তাণ্ডব থেকে রেহাই পেতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এই রোহিঙ্গারা কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়। এদের এ দেশে আশ্রয় নেওয়ার পেছনে একটি দালালচক্র কাজ করছে বলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করা হয়েছে।
আজ বিজিবি অধিনায়ক জানান, এই সময়ে কয়েকজন রোহিঙ্গাকে থানায় হস্তান্তর করে অনুপ্রবেশে সহযোগী দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সহায়তার দায়ে বাংলাদেশি ২৫ নাগরিককে আটক করে মোবাইল কোটের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
এখনো সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দালালের সহায়তায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবিকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার থাকায় তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবির সতর্ক অবস্থান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান বিজিবির অধিনায়ক।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতন-হামলা-ধর্ষণ ও তাদের বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা ওঠে। অনেকে সেখানে ‘গণহত্যা’ চলছে বলেও দাবি করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের বিষয়টি অবগত করে। গত ২৯ ডিসেম্বর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় আবারও উদ্বেগ জানায় বাংলাদেশ।
সেদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় গত ৯ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া আগে থেকেই তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে রয়েছে।’
রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নিতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
তবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মতে, এই সময়ে ৪৩ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে এসেছে। তবে নিবন্ধিতদের হিসাব দিয়েছে। এঁদের মধ্যে কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৭ থেকে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন ১২ হাজার। আর শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছেন আট থেকে নয় হাজার রোহিঙ্গা। বাকি রোহিঙ্গারা টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন গ্রামে আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিতজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।
এর আগে ২০১২ সালের জুনেও মিয়ানমারে সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। ওই সময় সরকার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শক্ত অবস্থান নেয়। যার ফলে ওই সময়ে সাড়ে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা পুশব্যাক করা হয়।