স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে ৩ মেয়াদি প্রস্তাব বিএনপির
স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। আজ মঙ্গলবার (৪ ফ্রেব্রুয়ারি) রাজধানীর গুলশানে দলটির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিন মেয়াদি প্রস্তাব তুলে ধরেন স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
স্বল্পমেয়াদি (১-৩ বছর)
প্রতিরোধের মাধ্যমে সুরক্ষিত স্বাস্থ্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে ইউনিয়ন সাব-সেন্টার উন্নয়ন ও পর্যাপ্ত সংখ্যক ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহকারী’ নিয়োগ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে- সেবার গুণগত মান উন্নয়ন এবং কার্যকরী প্রাথমিক রেফারেল সেন্টার হিসেবে রুপান্তর, প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত সেবা নিশ্চিত করা, পুষ্টিবিদ ও পরিকল্পিত পরিবার ও জনসংখ্যার ব্যবস্থাপনা।
জিপি (জেনারেল ফিজিশিয়ান) অধীনে প্রত্যেক নাগরিককে একজন সরকারি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের অধীনে রাষ্ট্রীয় খরচে সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। বিদ্যমান দ্বিতীয় (জেলা ও সদর হাসপাতাল) এবং তৃতীয় স্তরের বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ ও সঠিক রেফারেল সিস্টেম বাস্তবায়ন।
কিডনি, ক্যানসার, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ চিকিৎসাসহ ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন, জরুরি সেবা, দুর্ঘটনা পরবর্তী সেবা, দ্রুত রোগী স্থানান্তর ব্যবস্থাপনা।
স্বাস্থ্যসেবায় ন্যায় বিচার, রোগী ও সেবা প্রদানকারীর জন্য সমতাভিত্তিক আইন প্রণয়ন। সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে চিকিৎসক ও রোগী সম্পর্ক উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও মিডিয়ার যথাযথ এবং ইতিবাচক ব্যবহার।
মধ্যমেয়াদি (১-৫ বছর)
স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন ও স্বাস্থ্য কার্ডের মাধ্যমে সুবিধা প্রবর্তন।
দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। স্বাস্থ্য পর্যটন উপযোগী একটি আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নির্মাণ।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করার জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় ধরনের রোগের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। একই সঙ্গে গ্রামীণ জনগণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহকারী’ নিয়োগ করা, যার ৭০ শতাংশ হবে নারী। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিটি ইউনিয়নের শতভাগ জনসংখ্যাকে সেবার আওতায় আনা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে পর্যায়ক্রমে ১০০ শয্যায় উন্নীত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া। মাতৃসেবা, শিশু স্বাস্থ্যসেবা, জরুরি অস্ত্রোপচার সেবার সম্প্রসারণ করা। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ল্যাবরেটরী সরঞ্জাম ও অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা সংযুক্তকরণ।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় জেলা সদর হাসপাতালকে একটি অর্থবহ সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংযুক্ত ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থার মাধ্যমে সমন্বিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রদান করে রোগীদের জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা। কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি, অনকোলজি, পেডিয়াট্রিকস, গাইনোকোলজি, ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটসহ, জরুরি পরিষেবা এবং অস্ত্রোপচারের সুবিধা, এক্সরে, সিটি স্ক্যান, আলট্রাসোনোগ্রাফি ইত্যাদি ব্যবস্থা সংযোজন করা।
এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডের ইউনিট ও প্লাটের সক্ষমতা ও সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুতের শতভাগ সক্ষমতা অর্জন।
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ওষুধের (এপিআই) একটিভ ফার্মাসিটি ফার্মাসিউটিকাল উপাদান দেশেই উৎপাদনের ব্যবস্থা করা।
রপ্তানিযোগ্য ওষুধের আইটেম ও পরিধি বৃদ্ধি এবং দেশের রপ্তানি ঝুঁড়িতে সম্ভাবনাময় তৃতীয় খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ও আগামী ৫ বছরের মধ্যে এর পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ।
অংশীজনের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সকল সেবার মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা।
লিখিত বক্তব্যে স্বাস্থ্য খাতে বিগত ১৫ বছরের অনিয়মের করণীয় তুলে ধরে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিগত আওয়ামী শাসনকালে স্বাস্থ্যখাতে আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়মসহ পদোন্নতি, বদলি, প্রশাসনিক দুর্বিত্তায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধনের সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে দলীয়করণের আবরণে আচ্ছাদিত করা হয়েছে ৷ অবিচার ও অন্যায়ের প্রাবল্যে স্বাস্থ্য খাতের জনবলের পেশাগত দক্ষতার চরম ক্ষতি সাধিত হয়েছে ৷’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘স্বাস্থ্য সেবায় জনগণের প্রত্যাশিত প্রাপ্তি বঞ্চিত হয়েছে ৷ সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তীব্র বিদেশমুখিতা সৃষ্টি হয়েছে ৷
চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের হয়েছে অবণতি ৷ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ হয়ে পড়েছে অনিরাপদ। সরকারি স্বাস্থ্য সেবার অধিক্ষেত্রে জনগণ উচ্চ মূল্যের বেসরকারি চিকিৎসা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন সুষ্ঠু তদন্ত ও পর্যালোচনার মাধ্যমে দুর্নীতির নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান।
পর্যায়ক্রমিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার বৈশ্বিক মান নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশের ডাক্তার, নার্স এবং টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ প্রদান; যাতে তারা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করেন।
সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি সবার মতামতকে পুনঃমর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে জনগণের কল্যাণে স্বাস্থ্য সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করছি। তারা যদি গ্রহণ করে তাহলে আগামী দিনে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে তা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ড. মোশাররফ বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাত পরিবর্তন করতে দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে। প্রয়োজনীয়তা দিক বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিক ব্যবস্থা নেবে।’
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত থেকে রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কম ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন—বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফরহাদ হালিম ডোনার, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান প্রমুখ।