‘করোনার চেয়ে ভাতের কষ্ট বেশি!’
ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে এফডিসিতে যাওয়া-আসা। তারপর সহশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন হাজারেরও বেশি ছবিতে। তবে অভিনয়শিল্পী হিসেবে নয়, ‘এক্সট্রা’ হিসেবে। এ কারণে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্য নন তিনি। বর্তমানে চলচ্চিত্রে কাজ কম, তাই চলচ্চিত্র কর্মীদের কাছে হাত পেতেই চলছিল সংসার। তবে করোনাভাইরাস আতঙ্কে সবাই যখন ঘরে বসে আছেন, তখনও এফডিসিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বুলু বারী। শুধু তিনি নন, তাঁর মতো অনেকেরই দেখা মিলবে এফডিসিতে।
একটি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অংশে আমরা অনেককেই দেখি। যাঁদের কোনো সংলাপ নেই, কেন্দ্রীয় বা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর পাশে তাঁদের দেখা যায়, তাঁদেরকে মূলত এক্সট্রা শিল্পী বলা হয়।
বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অভিনেত্রী বিলকিস বারীর মেয়ে বুলু বারী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সিনেমার কাজ বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। তারপর থেকে এফডিসিতে ঘুরে ঘুরে, এর-ওর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে চলছি। এখন করোনাভাইরাসের জন্য তো সবই বন্ধ। এফডিসির সংগঠনগুলোও নিজেদের অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ আসে না। টাকা দেয় না কেউ। গতকাল হেঁটে এসেছি, হেঁটে গিয়েছি। সারাদিন খাইনি কিছুই। মনে হয়, ভাতের অভাবেই এবার মারা যাব!’
তবে কি করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ভর করছে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে বুলু বলেন, ‘মরণ তো আছেই, করোনার চেয়ে ভাতের কষ্ট বেশি। আমাদের মতো যাদের একবেলার খাওয়া অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়, তারাই জানি খিদের জ্বালা কাকে বলে। করোনায় মারা গেলে কতটা কষ্ট হবে, সেটা জানি না। তবে খিদেয় মরতে চাই না।’
একই সুরে কথা বলেন রানু বেগম, সালাম, বুরহান উদ্দিন। এফডিসির আমতলায় তাঁরা একসঙ্গে বসে আলাপ করছিলেন। কেউ একজন আসলেই তাকিয়ে দেখছেন, কেউ পরিচিত কি না। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় তাঁদের।
রানু বেগম বলেন, ‘দেখেন ভাই, আমরা যারা এক্সট্রা শিল্পী, যাদের কোনো ডায়ালগ নাই, তারা কিন্তু শিল্পী সমিতির সদস্য না। আমরা ছবিতে অভিনয় করি, ঝাড়ুটাড়ু দিই, বিনিময়ে যে টাকা পাই, তা-ই দিয়ে সংসার চলে। কাজ না থাকলে যাঁরা এফডিসিতে আসেন, দোকান থেকে তাঁদের চা-সিগারেট এনে খাওয়াই; তাঁরা কিছু টাকা দেন। এখন তো সবই বন্ধ। দুদিন ধরে বলতে গেলে না খেয়েই আছি।’
বুরহান উদ্দিন বলেন, ‘অভিনয়কে ভালোবেসে সেই ছোটবেলায় এফডিসিতে এসেছি। তারপর থেকে ট্রলি বয় হিসেবে কাজ করছি। পাশাপাশি ছোটখাটো অভিনয় তো করছিই। তবে টাকার অভাবে আর কোনো কিছু ভালো লাগে না। মহাখালি বস্তিতে থাকি, সেখানে সবাই জানে আমরা চলচ্চিত্রের লোক। সেই হিসেবে সেখানে আমাদের একটা ইজ্জতও আছে। এ কারণে ভিক্ষাও করতে পারি না। তাই খিদে পেটে নিয়ে মুখ বুজে এফডিসিতে পড়ে থাকি।’
করোনাভাইরাসের আতঙ্কে বন্ধ হয়েছে সিনেমা হল, শুটিংও বন্ধ। গৃহে রয়েছেন তারকারা। স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরাও।
এফডিসিতে এক্সট্রা শিল্পীর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এঁদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকলেও বুলু-রানুদের মতো অসহায় শিল্পী রয়েছেন পাঁচ শতাধিক, যাঁদের অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো পথ নেই। এমন অবস্থায় কী হবে তাঁদের, এমন প্রশ্ন রাখা হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের কাছে।
এ বিষয়ে জায়েদ খান বলেন, ‘আমরা সব সময় সমিতির অসচ্ছল শিল্পীদের পাশে দাঁড়াই। তবে যাঁরা আমাদের সমিতির সদস্য নন, তাঁদের জন্য বিশেষ কিছু করার সুযোগ কম। এর পরেও যাঁরা নিয়মিত এফডিসি আসেন, এমন এক্সট্রা শিল্পীদেরও পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। আগামী ২৬ মার্চ এফডিসিতে আমরা অসচ্ছল শিল্পীদের চাল-ডাল, তেল-লবণ দেব। তখন এই পরিচিত মুখগুলো... আমাদের সদস্য না হলেও, তাঁদের জন্য বরাদ্দ থাকবে।’
তেমন সহায়তার আশায় রয়েছেন বুলু-রানুরা। করোনার প্রভাব দেশ থেকে দূর হোক, এমন আশা সবারই।