ক্যানভাস আবেগ ধরে রাখার জায়গা : বিপাশা
আজ সন্ধ্যা ৬টায় বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে উদ্বোধন করা হচ্ছে চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াতের ‘রেল্মস অব মেমোরি’ শীর্ষক তিন সপ্তাহব্যাপী একক চিত্রকর্মী প্রদর্শনীর। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে উদ্বোধন করবেন কোরিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রদূত লি ইউন ইয়াং এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম। প্রদর্শনীটি আগামী ২৯ অগাস্ট ২০১৫ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। প্রদর্শনীতে তাঁর একক ২৮টি চিত্রকর্ম এবং আটটি ড্রয়িং প্রদর্শিত হবে। বিপাশা হায়াত বলেন, ‘আমার ছবির টুকরো অংশগুলো প্রতিনিধিত্ব করে আমার টুকরো স্মৃতিগুলোকে। আর যে লাইনগুলো দিয়ে এগুলো আলাদা করা সেটা একে আহ্বান করে আমার বর্তমানে। ক্যানভাসটা আসলে এ দুটি সময়-অতীত বর্তমান এবং আমার মৌলিক আবেগ ধরে রাখার জায়গা।’ নিজের চিত্রকর্ম, ব্যক্তিগত জীবন ও অন্যন্য বিষয় নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অভিনেত্রী, লেখক ও চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াত।
প্রশ্ন : ‘রেল্মস অব মেমোরি’ -প্রদর্শনীর নাম দিয়েছেন। ছবিগুলো আপনার কোন সময়ের স্মৃতি থেকে আঁকা?
উত্তর : সব সময় ছবিতে আমি একটা গঠন রাখার চেষ্টা করি। ছোটবেলায় লিবিয়ায় আমার অনেক দিন কেটেছে। সেখানে রোমান সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ আমি দেখেছি। আমার মনে হয় ওগুলো আমার ছবিতে উঠে এসেছে। সেই ভাঙা টুকরোগুলোর সঙ্গে অনেক স্মৃতি আমি জমিয়ে ছবিগুলো আঁকার চেষ্টা করেছি। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির বিমূর্ত আবেগকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমার শিল্পকর্মে। অবেচতন মনে ছোটবেলার এটাই ছিল আমার শক্তিশালী স্মৃতি। আমার মেয়ে এখন ছবি আঁকার চেষ্টা করে কিন্তু ওর ছবিতে অনেক রঙ থাকে। ও হলুদের মধ্যে হলুদ রঙই বেশি করে দেয়। ছবিটাকে ও অনেক রঙিন করার চেষ্টা করে। একদিন এটাই ওর কাছে স্মৃতি হবে।
প্রশ্ন : আপনার মায়ের ইচ্ছে ছিল আপনি স্থপতি হবেন। আপনার কী হওয়ার ইচ্ছে ছিল? এখন আপনি একাধারে অভিনেত্রী, লেখক ও চিত্রশিল্পী। নিজেকে কোন পরিচয়টা দিতে ভালো লাগে?
উত্তর : মা খুব চেয়েছিলেন আমি স্থপতি হই। আমার বাবা প্রকৌশলী তাই মায়ের ধারণা ছিল যারা এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে তারা অনেক ভালো মানুষ হয়। তাই তিনি চাইতেন আমি এ বিষয়ে পড়াশোনা করি। আমি বুয়েটে পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। তারপর ওয়েটিং লিস্টে থাকি। আমার আগের জনও টিকে যায়, কিন্তু আমার আর ভর্তি হওয়া হয়নি। বাসায় সেদিন সবাই কান্নাকাটি করেছিল। এমন পরিস্থিতি হয়েছিল, মনে হয়েছিল কেউ যেন মারা গেছে। এরপর আমি ইডেন কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। মঞ্জুরুল স্যার তখন ইডেনের প্রফেসর ছিলেন। আমি তিন মাস ইংরেজি সাহিত্য পড়ি। ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও আমার আগ্রহ ছিল। মঞ্জুরুল স্যার কবিতা পড়াতেন। আমরা ক্যাম্পাসে অনেক মজা করতাম। সেই সময়টাও ভালো কেটেছিল।
তারপর আমি আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেই এবং প্রথম হই। এরপর আম্মা বলেছিলেন, ‘আমাকে আগে দেখতে হবে আর্ট কলেজের পরিবেশ কেমন, কারণ আমি শুনেছি ওখানে সবাই গাঁজা খায়। তারপর আম্মা আমার সঙ্গে আর্ট কলেজে গিয়েছিলেন। পুরো ক্যাম্পাস ঘোরার পর আম্মা তো অনেক মুগ্ধ। তারপর আম্মা আমাকে বললেন, ‘তুমি এখানেই পড়, অনেক সুন্দর জায়গা।’
মা ছিলেন আমাদের পরিবারের চালিকা শক্তি। আম্মা বলতেন, ‘তোমরা ভালো মানুষ হও আর যা করতে ভালোবাস সেটা কর।’ আর আমার আব্বার অনেক আগে থেকে ইচ্ছে ছিল আমি যেন পেইন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করি। আমার অনেক আগ্রহ দেখে আব্বা আগে থেকেই রাজি ছিলেন। আল্লাহ্ প্রদত্ত আমি এই উপহারটা পেয়েছি তা না হলে চিত্রশিল্পী আমার পক্ষে হওয়া সম্ভব হতো না।
নিজেকে মা হিসেবে পরিচয় দিতে আমার ভালো লাগে। তবে অভিনয় থেকে নিজেকে আমি গুটিয়ে নিয়েছি। ভালো চিত্রনাট্য ছাড়া অভিনয় করছি না। এখন চিত্রকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই। আমি একসময় গান শিখেছি। প্রায় সাত-আট বছর গান করেছি। কিন্তু এখন সেটা করছি না। আমার কাছে মনে হয় মিউজিক, সাহিত্য, ড্রামা সবকিছুর ভেতরে পেইন্টিংয়ের যেমন ছাপ আছে, তেমনি ওগুলোর ভেতরে পেইন্টিং আছে। যখন আমরা মিউজিক শুনি তখন গানের গানের স্কেল উঁচু থেকে একদম নিচে চলে আসে। তার কারণ স্কেলটাকে প্রতিষ্ঠিত করা। স্কেলের গতি ওঠা-নামা করলে সেটা বোঝা যায় না। একটা গঠন থাকে। এ রকম রংও। কারণ লালের পাশে কমলা ব্যবহার করলে একরকম আবার হলুদ ও সবজু রং ব্যবহার করলে সেটার অনুভূতি অন্যরকম। আবার নাটকের মধ্যেও অনেক নাটকীয়তা থাকে। হঠাৎ করে নাটক শুরু হয়ে মূল গল্পে চলে যায় না। ছোট ছোট ঘটনা থেকে মূল গল্প শুরু হয়। এ থেকে বোঝা যায়, প্রত্যেক জায়গায় ওঠা-নামার বিষয়টি আছে।
আর্টে এসবের সব নিযার্স পাওয়া যায়, যা আমি অনুভব করতে পারি। আল্লাহর কাছে আমি সব সময় শোকর করি, কারণ শিল্পের ভেতরে সব সময় আমি একজন কর্মী হয়ে কাজ করতে পারছি। আমি সত্যি নিজেকে শিল্পী মনে করি না। শিল্পী অনেক বড় ব্যাপার, অনেক সাধনার ব্যাপার। আমরা দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুর ভেতর দিয়ে কাজ করি। পল সেজান যেমন পরিবার পরিজন ছেড়ে দিয়ে বনের গহীনে গিয়ে পাহাড় নিয়ে ছবি এঁকেছেন। এটা কিন্তু সাধনার বিষয় ছিল। তিনি একটা গির্জার ছবি ৩২ বার এঁকেছেন। সূর্যের আলো একেক সময় বিভিন্নভাবে পড়ছে এটাও ৩৪ বার এঁকেছেন তিনি। শিল্পের জন্য যে সাধনা করে তাকে আমরা শিল্পী বলব। এ জন্য নিজেকে আমি কর্মী বলতে সাচ্ছান্দ্যবোধ করি।
প্রশ্ন : আপনার শিক্ষকদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : রফিকুন নবী স্যার, শিশির স্যার, মাহমুদুল হক স্যার, ফরিদা জামান ম্যাম, জামাল আহমেদ স্যার, নেসার স্যার আমার শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা যখন ক্লাসে আসতেন আমাদের তাদের দেবতা মনে হতো। উনাদের কাজ আমরা ছোটবেলা থেকে দেখেছি। ক্যালেন্ডারের পাতাও তাদের ছবিও দেখেছি। কাইয়ূম চৌধুরী স্যার, হাশেম খান স্যার, কিবরিয়া স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের ক্যাম্পাসে আমরা দেখতাম। তাঁদের দেখে মনে হতো, স্বর্গ থেকে দেবদেবী নেমে এসেছেন। এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।
প্রশ্ন : সেসব শিক্ষকের সঙ্গে যখন একই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করছেন তখন আপনার কেমন লাগেছে?
উত্তর : আসলে বিষয়টি খুব আশ্চর্য লাগে। এটা আমি বলব আমার জন্য আশীর্বাদ। কারণ তাঁদের সঙ্গে আমার কাজ ঝুলছে, এতে আমার দায়িত্ববোধও বেড়ে যায়। আমাদের শিক্ষকরা সব সময় চাইতেন আমরা কাজ করি। তাঁরা এখন জানেন, আমি অভিনয় কম করেছি, চিত্রকর্মই বেশি করছি।
প্রশ্ন : চিত্রকর্ম নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : কতদিন বাঁচব আমি জানি না। তবে আমার একটা সময় পরিকল্পনা ছিল যে, একদিন আমি অভিনয় কমিয়ে দিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছবি আঁকব। আমি এখন সেই পথেই আছি। অভিনয় এখন আমাকে টানে না। ছবি আমাকে টানে। এক ধরনের ছবি আমি আঁকতে চাই না। বিভিন্ন ধরনের এবং বিষয় নিয়ে আমি ছবি আঁকতে চাই। এই প্রদর্শনীর পর আমি প্রকৃতি নিয়ে কাজ করব। কারণ এখন আমাকে প্রকৃতি আকর্ষণ করছে। আমার শরীরটা ছোট হলেও মনটা অসীম। আমার মন যেখানে টানবে- সেই কাজটাই আমি করব।
প্রশ্ন : তৌকির আহমেদ নতুন ছবির (অজ্ঞাতনামা) কাজ শুরু করেছেন? আপনি কি সেখানে কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছেন?
উত্তর : না, পাইনি। ( হেসে) আমি তৌকিরকে মজা করে বলেছিলাম তৌকির, আমাকে তোমার ছবিতে একটা ছোট পার্ট দাও, একটা ছোট সংলাপ বলব শুধু। আর যদি সেটা না দাও, আমাকে একটা আইটেম গান করার সুযোগ দাও। কিন্তু তৌকির দিল না। ছবিটি সত্য একটি গল্প অবলম্বনে হচ্ছে। আমরা দুজন দুজানার কাজকে অনেক শ্রদ্ধা করি। সমালোচনাও করি। তৌকিরের এই ছবিটি নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। মানবিক একটা গল্প। সবার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।
প্রশ্ন : তৌকির আহমেদ আপনার বন্ধু ছিলেন। এখনো কি আছেন?
উত্তর : আসলে বন্ধুত্ব থেকে আমাদের সম্পর্কের একটা উত্তরণ হয়েছে। আমার এত কাজ- এটা তৌকির ছাড়া সম্ভব হতো না। আমি রাত জেগে ছবি আঁকছি। প্রদর্শনীর জন্য বাচ্চা বাসায় রেখে বিদেশে যাচ্ছি। একজন স্বামী কি খুব সহজে এগুলো মানতে পারে? একজন বন্ধু সেগুলো মানতে পারে। আমাদের দুজনের সাংসারিক আলাপ হয় না। আমরা যেমন সুন্দর যুগল, তেমনি আগের মতো বন্ধুত্ব আমাদের মাঝে এখনো বিরাজমান।
প্রশ্ন : ‘নক্ষত্র বাড়ি’র কী খবর?
উত্তর : আমরা যতটুকু শিল্পের নির্যাস পেয়েছি, ঠিক ততটুকু দিয়ে আমাদের ‘নক্ষত্র বাড়ি’টা সাজিয়েছি। নক্ষত্র বাড়ির আর্কিটেকচার তৌকির দেখাশোনা করে। আমি বাগানবাড়িটা দেখি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অদ্ভূত এক যোগাযোগ আছে। প্রকৃতি সবার বড় শিক্ষক। ‘নক্ষত্র বাড়ি’র সব গাছের নাম আমি কিছুদিন পর লাগিয়ে দেব। ‘ নক্ষত্র বাড়ি’ করার জন্য আমরা যখন জমি কিনি তখন থেকে আমি গাছ লাগাতে শুরু করি। সেই গাছগুলোর কথাও আমি বুঝতে পারি।
কিছুদিন আগে আমি মিয়ানমারে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে একটা গাছ নিয়ে এসেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে গাছটা আমার স্মৃতি বহন করবে। আর যখন আমার বাগানের নতুন গাছের পাতা হয়, তখন আমি বাচ্চাদের ডেকে নিয়ে এসে দেখাই। আমি চাই, তারা সে পাতার নিযার্সটুকু নিক। এভাবে বড় হোক তারা।