বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে যা বললেন শাওন
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের বিবাহবার্ষিকী ছিল গতকাল ১২ ডিসেম্বর। এ উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শাওন আবেগঘন একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন আজ। এ ছাড়া তিনি শেয়ার করেছেন তাঁদের বিয়ে ও গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের বেশ কিছু ছবি।
নিউইয়র্কে কাটানো দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করে শাওন বলেন, “২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ছিল হুমায়ূনের পঞ্চম কেমোথেরামির দিন। আমরা তখন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় ১৪৮-০১ নম্বর বাসার দোতলায় থাকি। নিচতলাটা খালি। দোতলার ওপরে ছোট্ট একটা অ্যাটিক। অর্ধেক উচ্চতার ওই অ্যাটিকে হুমায়ূন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। কিন্তু জায়গাটা তাঁর খুব পছন্দের। তার ট্যানটা বাবা নিষাদ হুমায়ূনকে সঙ্গে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি সেখানে ছবি আঁকেন। সারা অ্যাটিক রঙে মাখামাখি হয়ে যায়, বাধা দেওয়ার কেউ নেই। কোনো ছবির নীল আকাশটায় তুলো তুলো মেঘগুলো সাদা রং করতে করতে কোমল গলায় পুত্রকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ছবিটা কেমন হয়েছে বাবা?’ ছবিতে গাছের নিচে দাঁড়ানো একাকী এর নারীকে দেখিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় পুত্র নিষাদ বলে, ‘এখানে নিষাদ একে দিলে আরো ভালো হবে বাবা। ছবির ভেতরে মা একা একা দাঁড়িয়ে আছে, ভয় পাবে।’ হুমায়ূন পুত্রের হাতে রংতুলি তুলে দেন। নিষাদ নিজেই একটা ছোট বাচ্চা এঁকে দেয় ছবির মেয়েটির পাশে। এভাবে চলতে থাকে পিতা-পুত্রের রঙের খেলা। কোনো কোনো ছবি দেখে পুত্র হঠাৎ বলে ওঠে, ‘এই ছবিটা একদম পচা হয়েছে বাবা।’ পুত্রের সমালোচনায় কপাল কুঁচকে মনোযোগী হয়ে কিছুক্ষণ ছবির দিয়ে তাকিয়ে থাকেন হুমায়ূন। তারপর ঘ্যাচাং করে ছিঁড়ে ফেলেন সেই ছবি! গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, ‘আসলেই ছবিটা ভালো হয়নি বাবা। পচা হয়েছে।’”
স্মৃতির ঝুড়ি খুলে শাওন আরো বলেন, “মাঝেমধ্যে একা আমি অ্যাটিকে যাই, ছেঁড়া টুকরোগুলো হাতে করে জুড়ে দেখি। আমার বড় ভালো লাগে। ১১ ডিসেম্বর রাতে আমাকে অ্যাটিকে ডাকলেন হুমায়ূন। তাঁর সামনে একটা সাদা কাগজ, পানিতে ভেজানো। তিনি পানি থেকে কাগজটা তুললেন। তারপর একটু একটু করে জলরঙের ছোপ পড়তে লাগল ভিজে পাতায়। হুমায়ূন টুকটুক করে আমার সঙ্গে গল্প করছেন। সাত বছর আগের সেই একই দিনের গল্প। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তার হাতের কাগজটার দিকে! কী সুন্দর জলছবি তৈরি হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যে! ছবিখানা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে হুমায়ূন বললেন, এই নাও, তোমার বিয়েবার্ষিকীর উপহার। ১২ ডিসেম্বর সকাল ১১টা। হুমায়ূন আর আমি বসে আছি মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো অংকোলজি ডিপার্টমেন্টের সাজানো লবিতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ডক্টর স্টিফেন আর ভিচ আমাদের ডেকে নিলেন তাঁর ঘরে। পরিচিত হাসিখানা ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘How’re you doin’ Dr. Ahmed? You’re looking happy today! Is there anything that I missed..!’ হালকা রসিকতায় ভ্রু নাচালেন তিনি। ‘হুম তুমি রসিকতা করছ! একটু পরেই তো আমাকে গাদাখানেক সুই ফোটাবে! আজ আমার বিয়েবার্ষিকী, কোথায় দুজন মিলে একটু ঘুরব-ফিরব! তা না…আমি বসে আছি কেমোথেরাপির অপেক্ষায়!’ সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ডক্টর ভিচ! হাতের কাগজটায় খসখস করে লিখলেন কী যেন! তারপর বললেন, ‘তোমাদের আজ ছুটি দিয়ে দিলাম। কেমোথেরাপি কাল হবে। যাও সুন্দর করে বাঁচো আজকের দিনটা।’ আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। ম্যানহাটনের রাস্তায় রাস্তায় এলোমেলো হেঁটে বেড়ালাম! শুধু আমরা দুজন! পথচারীদের জিজ্ঞেস করে করে চায়না টাউন খুঁজে বের করে দুপুরের খাবার খেলাম। দৌড়ে গিয়ে বাস ধরলাম, টিকেট ছাড়া সাবওয়েতে ঢুকে পড়লাম! সে কি পাগলামি আমাদের দুজনের! সে কি ছেলেমানুষি! হ্যাঁ, আমরা দুজন। আমরা কেঁদেছি, আমরা হেসেছি। আমরা ভালোবাসায় ভেসেছি। আমরা ছোট ছোট চাহনিতে মুহূর্তটা বেঁধেছি। ১২ ডিসেম্বর ২০১১, একসঙ্গে আমাদের শেষ বিয়েবার্ষিকী।”
পেশাজীবনে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। পরে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে লেখালেখিতে নিয়মিত হোন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা তিন শতাধিক। এর মধ্যে অন্যতম উপন্যাসগুলো হলো ‘নন্দিত নরকে’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘মাতাল হাওয়া’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা উপন্যাসের জনপ্রিয় চারটি চরিত্র হলো হিমু, রুপা, মিসির আলী ও শুভ্র।
অন্যদিকে তাঁর নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে ‘আগুনের পরশমণি’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘চন্দ্রকথা’ ও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি এই লেখক ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ইন্তেকাল করেন।