১৫ বছরে সিসিমপুর
হালুম, টুকটুকি, ইকরি কিংবা শিকু—আমাদের দেশের শিশুদের কাছে নামগুলো অতি পরিচিত এবং অতি প্রিয়। বলা হচ্ছে জনপ্রিয় শিশুতোষ সিরিজ সিসিমপুরের কথা। দেশের শিশুদের শেখাকে আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য করার লক্ষ্য নিয়ে ‘সিসিমপুর’ নামে যে টেলিভিশন অনুষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে, সে তা ১৪ পেরিয়ে পা রাখল ১৫তম বছরে!
চৌদ্দ বছর ধরে শিশুতোষ এই অনুষ্ঠানটি নির্মিত হচ্ছে তিন থেকে আট বছর বয়সী শিশুর প্রারম্ভিক শিক্ষার চাহিদা পূরণের জন্য। সেইসঙ্গে তার লক্ষ্য শিশুর পিতামাতা এবং শিক্ষকরাও। আনন্দ আর খেলার ছলে সিসিমপুর ভূমিকা রেখে চলেছে শিশুর সামগ্রিক বিকাশে। ভাষা-বর্ণ; গণিত; পরিবেশ; জেন্ডার সমতা; সামাজিক মূল্যবোধ ও আচার-আচরণ; ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীলতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শেখায় সিসিমপুরের পাঠক্রম। আছে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার; স্বাস্থ্যকর অভ্যাসচর্চা; ভূমিকম্প; রাস্তা পারাপার ও পানিডুবি-বিষয়ক নিরাপত্তা; বিভিন্ন আঘাত প্রতিরোধে সচেতনতা; শিশুদের জমা-খরচ ও সঞ্চয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসহ আরো অনেক কিছু।
সিসিমপুর তার টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও মুদ্রিত বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে শিশুকে বর্ণ চেনা, শব্দ থেকে বর্ণ চিহ্নিত করা, বর্ণ দিয়ে শব্দ মেলানো, শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করতে সাহায্য করে। চারপাশের পরিবেশ থেকে উপকরণ খুঁজে নিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে বর্ণ ও শব্দ চিনতে সাহায্য করে। যেমন : ঘর, কলা, আম, টেবিল, ঘড়ি, গরু, গাছ, পাতা, কলম, বই ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দ কোন বর্ণ দিয়ে শুরু হয় তা খেলার ছলে শেখানো হয়। সিসিমপুরের চরিত্রগুলোর মাধ্যমে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান থেকে বিভিন্ন রকম আকার-আকৃতির নাম, রঙের নাম ইত্যাদি শেখানো হয়। বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়টিকে সিসিমপুর সব সময়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে। আর তাই সিসিমপুরের মাপেট, মানবচরিত্র এমনকি অ্যানিমেশন—সব ধরনের টেলিভিশন পর্বে—চরিত্র অনুযায়ী প্রত্যেকের শুদ্ধ উচ্চারণকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে শিশুরা এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রমিত বাংলা শোনার ও চর্চা করার সুযোগ পায়। সিসিমপুরের নানাবিধ শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের ফলে শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ যেমন আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে শিক্ষকদের শিক্ষাদানও হয়েছে আনন্দদায়ক।
সিসিমপুর প্রচারের বর্তমানে একাদশ সিজন চলছে। তৈরি হচ্ছে ত্রয়োদশ সিজন। শুরু থেকে প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে সারা দেশের প্রায় এক কোটি দর্শক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, যেমন—চ্যানেল আই, দেশ টিভি ও চ্যানেল নাইনে প্রচারিত হয়েছে। বর্তমানে জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটি আরটিভি ও বিটিভিতে প্রচারিত হচ্ছে।
২০১০ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্ট পরিচালিত একটি জরিপে সিসিমপুর শিশুতোষ অনুষ্ঠান হিসেবে শীর্ষস্থানীয় এবং সামগ্রিকভাবে তৃতীয় জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হয়েছে। ২০০৭ সালে পরিচালিত এসিপিআরের একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু সিসিমপুর অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখে, তারা তাদের চাইতে এক বছরের বড় শিশু, যারা সিসিমপুর দেখে না, তাদের চেয়ে ভাষা ও বর্ণ, গণিত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ে বেশি দক্ষতা প্রদর্শন করেছে।
সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশ তার সব কার্যক্রমই সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে যৌথভাবে পরিচালনা করে থাকে। গত চৌদ্দ বছরে সিসিমপুর বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে। ইউএসএআইডির অর্থায়নে সিসিমপুরের পথচলার শুরু। নিউইয়র্কভিত্তিক সিসেমি স্ট্রিট নামক শিক্ষামূলক টেলিভিশন-ধারাবাহিকের যৌথ প্রযোজনা সিসিমপুরের কার্যক্রম বাংলাদেশে পরিচালনা করছে সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সরকার এবং ইউএসএআইডি বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সহযোগিতায় ২০১০ সাল থেকে সিসিমপুর আউটরিচ প্রকল্পটি দেশের ৬৪টি জেলায় ৩৩৪০টি স্কুলে সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশের কারিগরি সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ছাড়া সিসিমপুর প্রতিনিয়ত নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রচারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশ তার সব কার্যক্রমই সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে যৌথভাবে পরিচালনা করে থাকে। অনুষ্ঠানটির সহযোগী প্রযোজক হিসেবে শুরু থেকে এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছে এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশন লিমিটেড।
সিসিমপুরের মূলমন্ত্র : পৃথিবীটা দেখছি, প্রতিদিন শিখছি। আর তাই তো, ১৫ পেরিয়ে ২০, ৫০, ১০০ বছর... একদিন সূর্যের সমান প্রাচীন হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চলছে সিসিমপুর, বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর প্রাক-শৈশবকে পূর্ণাঙ্গ ও বিকশিত করবে বলে।