একা একা রবো নিরালায়…

‘যদি কোনোদিন আমার পাখি, আমায় ছেড়ে উড়ে চলে যায়, একা একা রবো নিরালায়…।’ মানুষের মুখে মুখে ফেরে ওই গান। শুধু কি এই গান? প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে ‘আমার এই দুটি চোখ’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’ ‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’ গানগুলো ছিল অসম্ভব প্রিয়।
গানগুলো অসম্ভব দরদ দিয়ে গেয়েছেন সুবীর নন্দী। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই গায়ক সত্তরের দশক থেকে চলচ্চিত্রে গান গাইতে শুরু করেন। বরেণ্য এই সংগীতশিল্পী আর নেই। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৪টায় মারা যান তিনি।
সুবীর নন্দী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দীপাড়ায় এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সময়টা ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩। তাঁর নানাবাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাদেআলিশা গ্রামে। তাঁর পিতা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সংগীতপ্রেমী। তাঁর মা পুতুল রানী চমৎকার গান গাইতেন; কিন্তু রেডিও বা পেশাদারি শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেননি।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ভাইবোনদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিতে শুরু করেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। তবে সংগীতে তাঁর হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। বাবার চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশবকাল চা বাগানেই কেটেছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাগানেই ছিলেন।
চা বাগানে খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি স্কুল ছিল, সেখানেই পড়াশোনা করেন। তবে পড়াশোনার অধিকাংশ সময়ই তার কেটেছে হবিগঞ্জ শহরে। হবিগঞ্জ শহরে তাঁদের একটি বাড়ি ছিল, সেখানে ছিলেন। পড়েছেন হবিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে। তারপর হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুবীর নন্দী সেকেন্ড ইয়ারে পড়তেন।
১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণি থেকেই গান করতেন বরেণ্য এই সংগীতশিল্পী। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তাঁর গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানে ছিলেন বিদিত লাল দাশ। সুবীর নন্দী গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথম গান 'যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়'-এর গীত রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম।
৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন আড়াই হাজারের বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে। ১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। তিনি গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন ব্যাংকে।
দীর্ঘ ৪০ বছরের সংগীত ক্যারিয়ারে আড়াই হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন তিনি। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক।
গত ১২ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন সুবীর নন্দী ও তাঁর পরিবার। পয়লা বৈশাখে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা ফেরার পথে উত্তরায় কাছাকাছি আসতেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে সুবীর নন্দীর। এরপরই তাঁকে সেখান থেকে সরাসরি সিএমএইচে নেওয়া হয়।
১৮ দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৩০ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয় সুবীর নন্দীকে।