এক দুপুরে কর্ণিয়ার সঙ্গে

মধ্যদুপুর। ঠিক মাথার ওপর জ্বলছে সূর্য। গনগনে রোদ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ। এর ফাঁকে হালকা প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে পেঁজাতুলোর মতো শরৎশুভ্র মেঘ। তাও ক্ষণিকের জন্য। মেঘ আর রোদের এই লুকোচুরির মধ্যে দুলছে কাশফুল, কণ্ঠশিল্পী কর্ণিয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর তাঁর গুনগুন করে গাওয়া গান।
দীর্ঘ দিগন্ত ভরে উঠেছে কাশফুলে। কুড়িল বিশ্বরোড ধরে পূর্বাচলের দিকে ৩০০ ফুট, সড়কের পাশের জমিনে সেই শারদচিহ্ন। কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় মনপ্রাণ ভরে ওঠে। কর্ণিয়া নিজেও জানালেন, ‘এত উষ্ণ রোদ। তবু কাশফুল দেখেই মনটা চনমনে হয়ে উঠল। কী সুন্দর!’
আমাদের মনও কাশফুলের মতো শুভ্র হয়ে উঠল। এর আগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কর্ণিয়ার বাড়ি খুঁজতেই লেগে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু সেই ক্লান্তি মুছে দিয়েছিলেন এসেই। আকাশি রঙের জর্জেট শাড়ি পরিহিত কর্ণিয়া করমর্দন করে বললেন, ‘আমি কর্ণিয়া, সবার চোখের মণি।’ আমরাও বললাম, ‘হ্যাঁ তাই তো।’
এরপর কাশবনে শুরু হলো আমাদের আড্ডা। কর্ণিয়া জানালেন, তাঁর দেশের বাড়ি ঝিনাইদহ হলেও জন্ম নানুবাড়িতে, মাগুরায়। কিন্তু বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরেই। এখানেই লেখাপড়া, গানবাজনা সবকিছু। ঘরে তাঁকে ‘কর্নস’ বলে ডাকা হয়। পুরো নাম জাকিয়া সুলতানা কর্ণিয়া। স্টুডেন্ট হিসেবে খুব খারাপও ছিলেন না, খুব ভালোও ছিলেন না। তবে রেজাল্ট নাকি ভালো করতেন। খুব বেশি বন্ধুবান্ধব ছিল না।
কর্ণিয়া বললেন, ‘বহুবার স্কুল পালিয়েছি। বাইন্ডিংস ব্যাপারটা কখনোই ভালো লাগত না। আমি স্বাধীনচেতা মানুষ। আমাকে কেউ জোর করে কিছু করাতে পারত না। স্কুল ফাঁকি দিতাম, দারোয়ানকে মিথ্যা কথা বলে চলে যেতাম। কলেজে একবার স্যারের কাছে ধরাও খেয়েছিলাম। খুব বান্দর ছিলাম।’
বাবা বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। মায়ের কাছেই প্রথম গান শেখা সংগীতশিল্পী কর্ণিয়ার। বললেন, ‘মায়ের কাছেই হাতেখড়ি। এরপর আমার প্রথম ওস্তাদজি হচ্ছেন টিটু শিহাব। উনি এয়ারফোর্সে জব করতেন। ওনার কাছেই আসলে আমার বেসিকটা শেখা—সারগাম, রাগসংগীত, ক্লাসিক্যাল—এগুলো আমি তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। আমার মনে হয়, উনি আমাকে যা শিখিয়েছেন, যা দিয়ে গেছেন, এর পর আর কারো কাছ থেকে তেমন শিখতে পারিনি। ওনার সঙ্গে আমার এখনো যোগাযোগ আছে। ওনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। তাঁর অন্য শিক্ষার্থীরা যখন আমার কথা বলে, তখন উনি খুব প্রাউড ফিল করেন।’
পপ, রক, ধ্রুপদি সংগীতসহ প্রায় সব ধরনের গানেই স্বাচ্ছন্দ্য কর্ণিয়ার। নিয়মিত স্টেজে গাইতেন। তবে ২০১২ সালে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের গানভিত্তিক শো ‘পাওয়ার ভয়েস’-এ অংশগ্রহণ করে রানার্সআপ হন। সেই থেকে প্রচারের আলোয় তিনি। অনেক মিক্স অ্যালবামে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গান। বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও গেয়েছেন।
ছোটবেলায় কর্ণিয়ার প্রিয় রং ছিল সাদা। বড় হওয়ার পর কালো। ‘কিন্তু এই মুর্হূতে আমি অনেক কালারফুল জিনিস, যেমন হলুদ, লাল, গোলাপি—এই ধরনের শকিং কালারগুলো বেশি ভালো লাগে,’ বললেন কর্ণিয়া। পশ্চিমা পোশাকেই স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর। কারণ হিসেবে বললেন, ‘আমার কাছে এটা শর্টকাট লাগে। যেমন কোনো একটা জায়গায় যাব, জিন্স আর টপ পরেই চলে গেলাম।’ শাড়িও পছন্দ কর্ণিয়ার। সাধারণত মা তাঁকে শাড়ি পরিয়ে দেন।
‘আজ আমি প্রথমবারের মতো নিজেই শাড়ি পরেছি। জানি না উল্টাপাল্টা অবস্থা। আম্মু আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেন। আজ একটু কাজ থাকায় নিজেকেই পরতে হয়েছে,’ বললেন কর্ণিয়া।
এবার প্রেমের ঝাঁপি খুললেন কর্ণিয়া। প্রথম প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলেন কলেজ জীবনে। মজার ব্যাপার হলো, যাঁর কাছ থেকে প্রথম প্রস্তাব পেয়েছিলেন, তাঁকে মনে মনে পছন্দ করতেন এ সংগীতশিল্পী। তবে নিজ থেকে কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দেননি কখনো। অনেককে ভালো লাগলেও আজতক নাকি কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দেননি কর্ণিয়া, কারণ যদি তিনি সাড়া না দেন। এই ভয়ে প্রস্তাবই দেওয়া হয়নি তাঁর। তবে প্রেমিক হিসেবে যাঁকে চান, তাঁকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। মুসলিম হিসেবে তিনি চান, তাঁর প্রেমিক বা স্বামী যেন ধার্মিক হন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন।
নিজের ভালো ও মন্দ দিকগুলোও প্রকাশ করলেন কর্ণিয়া। বললেন, ‘আমার ভালো দিক হচ্ছে, আমি কারো খারাপ চাই না। আমার শত্রু হলেও কখনোই তাঁর খারাপ চাই না। তাঁর জন্য দোয়া করি। বলি, আল্লাহ তাআলা তাঁর হেদায়েত দান করুন। আর আমার সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে, কাউকে যদি কোনো কারণে অপছন্দ করি, তাহলে তাঁকে জীবনেও ক্ষমা করতে পারি না এবং তাঁর সঙ্গে জীবনেও কথা বলতে চাই না।’
আড্ডার ফাঁকেই তোলা হলো কর্ণিয়ার ছবি। বললেন, ‘একটা কথা বলতে চাই, ওয়েস্টার্ন পোশাক পরলে অনেকে খারাপ মন্তব্য করে। এটা ঠিক নয়। পোশাক দেখে কাউকে বিচার করা ঠিক নয়।’ আর পার্সে ঠিক কী কী থাকা চাই? কর্ণিয়ার সাফ জবাব, ‘হাতে ফোন আর মানিব্যাগ থাকলেই চলবে।’
কর্ণিয়ার নিজের গাওয়া প্রিয় গান অনেক। এর মধ্যে ‘গাঙচিল’, আসিফ আকবরের সঙ্গে ‘কী করে তোকে বোঝাই’ অন্যতম প্রিয়। আজীবন গানের সঙ্গেই থাকতে চান কর্ণিয়া। বর্তমানকেই ভবিষ্যৎ মানেন। বলেন, গানের জগতে এসে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
‘অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। এখনো হচ্ছি। দেখা যায়, পজিটিভ না নেগেটিভই বেশি। অবশ্য আমি সবকিছু ইতিবাচকভাবে নিই। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, আমাকে ফেলে দেওয়ার জন্য অনেকে চেষ্টা করে, আমি সব সময় তাঁদের বলি, আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। আমি মনে করি, মানুষের পেছনে না লেগে নিজে কী করছি বা নিজের সৃজনশীলতার দিকে নজর দেওয়া জরুরি।’
এরপর কর্ণিয়ার কণ্ঠের জাদুতে দুলে ওঠে কাশবন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। ফিরি সেই রেশ নিয়ে।