চলচ্চিত্র ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে যা বললেন ‘রাঙা বউ’ ঋতুপর্ণা

দুপুরে হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি। অবশ্য সকাল থেকেই কালো আকাশ জল গড়ানোর পূর্বাভাস দিচ্ছিল। পরে তীব্রতা কমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরতে লাগল। রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকার জলকাদার আঁশটে গন্ধ ফুসফুসে ভরে আমরা এফডিসিতে পৌঁছালাম। সেখানে চলছিল ‘জ্যাম’ ছবির শুটিং। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তাঁর সান্নিধ্য না পেলে চলে?
২৫ অক্টোবর, দুপুর সাড়ে ৩টা। বিএফডিসির একটি ভবনের মেকআপ রুমে আয়নার সামনে বসে আছেন ঋতুপর্ণা। ঠোঁটে লিপস্টিক বুলাচ্ছেন। এর ফাঁকে কারো অনুরোধে সেলফিতে পোজও দিচ্ছেন। পাশেই বড় হলরুম। শুটিংয়ের নিমিত্তে সেখানে প্রায় অবিকল আদালত বসেছে। নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল পরিচালিত ‘জ্যাম’ ছবির দৃশ্যধারণ হবে। চলছে প্রস্তুতি। আমরা ঋতুর অপেক্ষায়। নায়িকা ঋতুপর্ণাকে তো সবাই ঋতুদি বলেই ডাকছেন। এই ছবিতে আইনজীবীর ভূমিকায় তিনি।
চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রায় ২৭ বছর রাজত্ব করে চলেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্যও ২২ বছরের। সেই ১৯৯৭ সালে ‘স্বামী কেন আসামি’ দিয়ে শুরু। এরপর ‘রাঙা বউ’, ‘তোমার আমার প্রেম’, ‘মেয়েরাও মানুষ’ থেকে হালের ‘আহারে’সহ অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। তা ছাড়া ঋতুপর্ণার পূর্বপুরুষদের শেকড়ও বাংলাদেশে। মায়ের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে আর বাবার বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে। নাড়ির টান বলে কথা!
সেসব কথাই উঠে এলো আলাপচারিতায়। এনটিভি অনলাইনকে জানালেন অভিনয় থেকে ব্যক্তিজীবনের ছিঁটেফোটাও।
বাংলাদেশে বহুবার এসেছেন ঋতুপর্ণা। নাড়ির টান ছাড়াও শুটিংয়ের প্রয়োজনে তাঁকে আসতে হয়। ঘুরেছেন কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবানসহ অনেক জায়গায়। মানিকগঞ্জে মায়ের গ্রাম বায়রাতেও ভ্রমণ করেছেন।
ভালো অভিনেত্রী হতে হলে কী কী গুণ থাকা চাই? ঋতুপর্ণা বললেন, ‘ধৈর্য। অনেক বছর কাজ করে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে—ধৈর্য যদি না থাকে, যদি কেউ মনে করে এটাই শেষ সুযোগ, তবে হবে না। আরো সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রত্যেকের জীবনেই লড়াই থাকে। অভিনয়শিল্পীদের লড়াইয়ের সময়টা অনেক বড়। কারণ, সব সময় তাঁদের একটা ভয় থাকে—কতটা গ্রহণযোগ্য হলো বা প্রত্যাখ্যাত হলো। তাই ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস দুটোই রাখতে হবে। জীবনে ব্যর্থতা থাকবেই, তাই বলে নিরীক্ষা থামানো যাবে না।’
একই সঙ্গে বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ধারার ছবিতে কাজ করে চলেছেন ঋতুপর্ণা। নিজেকে কীভাবে রূপান্তর করেন? ঋতুপর্ণা হেসে বললেন, ‘সেটাই তো আমার কাজ। আমি যত নিজেকে ভাঙব ও নিজেকে অন্যভাবে দেখাতে পারব, ততই দর্শকের সঙ্গে আমার যোগাযোগের জায়গাটা বেশি হবে। কারণ আমি আমার চরিত্র নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই। আমি চাই আমার চরিত্রগুলো দর্শকের কাছে অমর হয়ে থাক। শুধু অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত নামটা নয়, চরিত্রগুলোও যেন বেঁচে থাকে আমার দর্শকদের মধ্যে।’
নিজের পছন্দের চরিত্র? ঋতুপর্ণা বলেন, সেটা বলা মুশকিল। তবে তাঁর অনেক প্রিয় চরিত্র আছে। বিশেষ করে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’ ছবির চরিত্র ‘রমিতা’, যার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন; ‘রাজকাহিনী’র ‘বেগমজান’ তাঁর প্রিয়। বাংলাদেশের ছবির মধ্যে ‘রাঙা বউ’, ‘স্বামী কেন আসামি’, ‘মেয়েরাও মানুষ’ ছবির চরিত্রগুলো তাঁর প্রিয়। প্রয়াত নায়ক মান্নার সঙ্গে তিনি অনেক সিনেমা করেছেন, সেসব ছবির চরিত্রও তাঁর প্রিয়।
দেখুন ভিডিওতে :
বাংলাদেশে এখন ‘জ্যাম’ ছবির শুটিং করছেন। এই ছবির গল্পও বললেন ঋতুপর্ণা। ছবিতে আইনজীবীর ভূমিকায় দেখা যাবে তাঁকে। বলেন, ‘একটা জ্যামকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মানুষের জীবন কীভাবে বদলাচ্ছে এবং তখনই এই চরিত্রগুলো আসছে। পরবর্তীকালে যে সমস্যাগুলো হচ্ছে, সেগুলো তারা কীভাবে মেটাচ্ছে এবং সেখান থেকে আরো বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সেসব নিয়েই এ ছবি।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘রাঙা বউ’-এ খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় করে গোটা বিনোদনপাড়াই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। জুটি বেঁধেছিলেন প্রয়াত জনপ্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর সঙ্গে। অনেকেই অশ্লীলতার অভিযোগ তোলেন। সেই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসার জবাবে ঋতুপর্ণা বলেন, “শেষ পর্যন্ত ‘রাঙা বউ’ সুপারহিট ছবি। অনেক সাফল্য পেয়েছে ছবিটি। ‘রাঙা বউ’-এর সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ছিল—খুব গ্ল্যামারাস ছবি এবং খুব গ্ল্যামারাস একটা গল্প। ফরিদী ভাই খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি ও অসাধারণ অভিনেতা। আমরা চেষ্টা করেছি, যতটা ইন্টারেস্টিংভাবে দৃশ্যগুলো করা যায়। ছবির চরিত্রের মধ্যে অস্বাভাবিকতা ছিল, যেটা পরিচালক দেখাতে চেয়েছিলেন। তার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল ডিজব্যালান্স ছিল। অ্যাবনরমালিটি ছিল। তো সেই অস্বাভাবিকতাগুলো দেখাতে গেলে হয়তো কিছু কিছু জিনিস ক্রুড মনে হয়। শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয় অতটা করা হয়নি। তবে এখানে অবশ্যই কিছুটা সেনসিভিটি আছে দৃশ্যগুলো নিয়ে। সেই জায়গাগুলোতে হয়তো কিছুটা প্রভোকড হয়েছে।’
তবে ঋতুপর্ণা মত দেন, ‘রাঙা বউ’ অনেক বছর আগের ছবি। এত দিনে সেই ছবি গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রয়াত নায়ক মান্নার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল ঋতুপর্ণার। তাঁকে স্মরণ করে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘মান্না ভাই অসাধারণ মানুষ ছিলেন। মান্না ভাইকে সব সময় বর্তমানেই রাখি। আমি মনে করি, উনি আমাদের সবার মধ্যে বেঁচে আছেন। মান্না ভাই অত্যন্ত বড় মনের মানুষ ছিলেন। আমি ওনার খুব স্নেহভাজন ছিলাম। অনেক কাজ করেছি একসঙ্গে এবং সব সময় খুব আদর-স্নেহ পেয়েছি। মান্না ভাইয়ের চলে যাওয়াটা আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছে। আমি চাই, মান্না ভাই যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন—এখান থেকে আরো ভালো ভালো ছবি হোক—সেটা যেন পূরণ হয়।’
গত বছর ভারতজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল যৌননিপীড়নবিরোধী ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলন। বিনোদন দুনিয়া থেকে রাজনীতিপাড়ার অনেকেই অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কখনো কাস্টিং কাউচের (কাজের বিনিময়ে যৌনসুবিধা আদায়) শিকার হয়েছিলেন? উত্তরে ঋতুপর্ণা বলেন, ‘এটা চলতেই থাকে। অনেকের মতামত থাকে এর মধ্যে। আমি ঠিক অতটা মুখোমুখি হইনি বলে বলতে পারব না। যাঁরা বলছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলার গ্রাউন্ডস আছে। তাঁরা নিশ্চয়ই বিবেচনা করেই বলছেন কাস্টিং কাউচের কথাটা। তবে আমার মনে হয়, সব জায়গাতেই চ্যালেঞ্জেস আছে। সেগুলোকে যদি আমরা বড় করে না দেখে কাজটাকে বড় করে দেখি, আমার মনে হয় সেটাই বেটার আইডিয়া।’
সামনেই দুর্গাপূজা। বাংলাদেশের সব ভক্ত ও সিনেপ্রেমীদের শারদীয় শুভেচ্ছা জানান ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
যা হোক, ‘জ্যাম’ ছবির শুটিং শেষের দিকে। পরিচালক নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল জানিয়েছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরেই বড়পর্দায় উঠবে।