কোনালের বিশেষ স্মৃতিতে আইয়ুব বাচ্চু

২০০৯ সালে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আয়োজিত ‘সেরা কণ্ঠ’ প্রতিযোগিতার শিরোপা জিতেছিলেন সোমনুর মনির কোনাল। তখন অল্প বয়স। ওই সময়ই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, গিটারবাদক আইয়ুব বাচ্চুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন নতুন প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পী কোনাল।
গত বছরের ১৮ অক্টোবর একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক আইয়ুব বাচ্চু দেহত্যাগ করলেও ভক্ত ও সহযাত্রীদের মনে আজীবন বেঁচে থাকবেন।
আজ থেকে নয় বছর আগে কণ্ঠশিল্পী কোনালের সৌভাগ্য হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার। সে সময় তাঁর অল্প বয়স। পরম মমতায় বিদেশের মাটিতে কোনালকে আগলে রেখেছিলেন বাচ্চু।
কোনালের ভাষায়, ‘আমার জীবনের প্রথম যে সলো ট্যুর, সেই ট্যুরটা হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে। আমি তখন অনেক ছোট। আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে। সেরা কণ্ঠের পরপর। তো কীভাবে কী করতে হয়, কিছুই জানি না। সেটা ছিল ইংল্যান্ডে, বার্মিংহামে। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে শুধু বাচ্চু ভাইয়ের একটা কার্ড ছিল, তিনি সেখানে বসতে পারতেন। আরেকজনকে বসাতে হলে এক্সট্রা ডলারস দিয়ে বসাতে হতো। আমি যেহেতু অনেক ছোট, বাচ্চু ভাই আমাকে ডলারস দিয়ে এক্সট্রা লাউঞ্জে বসালেন এবং বার্মিংহামের প্রোগ্রাম শেষ করে ঢাকায় আসা পর্যন্ত আমার মনে আছে, মামা আমাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে গিয়েছিলেন।’
“মামার হাত থেকে তিনি আমাকে নিয়েছিলেন। মামাকে বলেছিলেন, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ও আমার ছোট বোনের মতো। আমি ওকে নিয়ে যাব।’ এবং তা-ই করেছেন বাচ্চু ভাই। প্রোগ্রাম শেষ করে আমাকে বাংলাদেশে মামার হাতে দিয়ে গেছেন। প্রোগ্রামে থাকাকালে যাবতীয় সব সহযোগিতা—প্র্যাকটিস নিয়ে, গান নিয়ে, গান নির্বাচনসহ সবকিছু বাচ্চু ভাই আমাকে করে দিয়েছেন। বাচ্চু ভাইয়ের এই ভালোবাসাগুলো, ছোটদের প্রতি সম্মান এবং এই সাপোর্টগুলো আজীবন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। বাচ্চু ভাই এতই মহতী আত্মা ছিলেন।”
এমন নানা স্মৃতিতে মানুষের মনে বেঁচে আছেন আইয়ুব বাচ্চু। যাঁদের সঙ্গে তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি, তাঁদের হৃদয়ে গেঁথে আছে সুরধ্বনি, তাঁর কণ্ঠ।
এনটিভি অনলাইনকে কোনাল আরো বলেন, ‘বাচ্চু ভাইয়ের অভাব অপূরণীয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা বিশ্বেই। কারণ, বাচ্চু ভাই একজন কিংবদন্তি শিল্পী। আমাদের দেশে শিল্পীদের ব্র্যান্ডিং কিংবা মার্কেটিংয়ের দিকটা খুব একটা ভালো ছিল না। শুধু ভালো কাজ করে বা শুধু মার্কেটিং করে হবে না—দুটোর সমন্বয় প্রয়োজন। বাচ্চু ভাইয়েরা যখন ছিলেন, শ্রেষ্ঠ কাজগুলো তাঁরা আমাদের দিয়ে গেছেন। সে সময় যদি আমরা প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকতাম, তবে বাচ্চু ভাইকেও হয়তো আমরা জন মায়ারের মতো—ও রকম মার্কেটিংটা আমরা সারা বিশ্বে করতে পারতাম। তবে বাচ্চু ভাইয়ের কাছ থেকে এখনো শিখছি। তিনি যা রেখে গেছেন, সেগুলোও যদি আমরা আয়ত্ত করতে পারি, সেটাও অনেক বড় ব্যাপার হবে।’
গান ছিল আইয়ুব বাচ্চুর অন্তরের ভাষা। গানকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। গায়ক থেকে হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃত শিল্পী। বিভিন্ন সময় কোনালকে নানা পরামর্শও দিয়েছেন।
‘বাচ্চু ভাই আজীবন বলেছেন, নিজের গানগুলোকে খুব যত্ন করে এক এক করে বাড়াতে হবে, করতে হবে, সুন্দর করে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে হবে। গানের সঙ্গে কখনো বেইমানি করা যাবে না,’ যোগ করেন কোনাল।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘এলআরবি’র দলনেতা ছিলেন তিনি।
১৯৭৮ সালে তিনি ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে পথচলা শুরু করেন। এরপর ১০ বছর সোলস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেন। নব্বইয়ের দশকে যাত্রা শুরু হয় ‘ব্যান্ডদল এলআরবি’র।
দীর্ঘ কয়েক দশকে অসংখ্য কালজয়ী, জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। ‘চলো বদলে যাই,’ ‘হাসতে দেখো,’ ‘এখন অনেক রাত,’ ‘রুপালি গিটার’, ‘মেয়ে’ ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি,’ ‘সুখের এ পৃথিবী,’ ‘ফেরারি মন,’ ‘উড়াল দেব আকাশে,’ ‘বাংলাদেশ,’ ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি,’ ‘এক আকাশের তারা,’ ‘সেই তারা ভরা রাতে,’ ‘কবিতা,’ ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি,’ ‘তিন পুরুষ,’ ‘যেও না চলে বন্ধু,’ ‘বেলা শেষে ফিরে এসে,’ ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি,’ ‘তিন পুরুষ’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। গত বছরের ১৮ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই কিংবদন্তি শিল্পী।