পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাবেন চয়নিকা চৌধুরী
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/09/photo-1431177125.jpg)
নির্মাতার কখনো লিঙ্গ হয় না। আমি অনেক খুশি, কারণ মেয়ে হয়ে এই পৃথিবীতে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। নারী নির্মাতা হয়ে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে আমাকে। সহজভাবে এই পথে হাঁটা কঠিন। আমি অনেক ভাগ্যবান, কারণ চলার পথে অনেক ভালো মানুষ পেয়েছি।’ নিজের কাজ ও আজকের অবস্থান নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে এভাবেই মনের ভাব প্রকাশ করেন এ সময়ের জনপ্রিয় নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী।
এ পর্যন্ত ২৭৪টি নাটক বানিয়েছেন তিনি। শুরুটা হয়েছিল নাটক লেখার মাধ্যমে।
১৯৯৮ সালে মাহফুজ আহমেদের বাণীচিত্র থেকে ‘বোধ’ নাটকটি নির্মাণ করেন ফারিয়া হোসেন। মাহফুজ আহমেদের অনুপ্রেরণায় নাটকটি লেখেন চয়নিকা চৌধুরী। নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন মাহফুজ আহমেদ ও শমী কায়সার।
নাটক পরিচালনা করবেন এটা কখনো ভাবেননি চয়নিকা চৌধুরী। নাটক পরিচালনার জন্য প্রথম তাঁকে প্রস্তাব দেন লাইট অ্যান্ড শ্যাডোর কর্ণধার মুজিবর রহমান।
চয়নিকা চৌধুরী বলেন, আমি খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। আমার আবেগ আমাকে অনেক কাজ করিয়েছে। কখনো ভুল কাজ করেছি আবার কখনো শুদ্ধ কাজ করেছি। মুজিব যখন নাটকের প্রস্তাব দিলেন, তখন অনেক বিস্মিত হয়েছি। তারপর তাঁর অনুপ্রেরণায় ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘শেষ বেলায়’ নাটকটি পরিচালনা করি। নাটকটিতে বাবা ও মেয়ের গল্প ছিল। অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, ঈশিতা ও জয়া আহসান। কিন্তু একজন ছেলে অভিনেতা পাওয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে গেল। কেন জানি কেউ আমাকে শিডিউল দেয়নি। পরে নাটকটিতে সতীর্থ রহমান ও সিজার অভিনয় করেছিলেন।’
প্রথম নাটক নির্মাণের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল জিজ্ঞাসা করতে চয়নিকা চৌধুরী বললেন, আমার স্বামী অরুণ চৌধুরী তখন অনেক তুখোড় পরিচালক। একটু ভয়ে ছিলাম যে নাটক বানানোর পর অরুণ ও অন্য কেউ পছন্দ করবে কি না। আমার নাটকের প্রথম ক্যামেরাম্যান ছিলেন হারুন আহমেদ খান। আমরা তাঁকে হারুন আংকেল ডাকতাম। আমি প্রতিষ্ঠিত কোনো সহকারী পরিচালকও নিইনি। একটা মেয়ে কাজ করেছিল। মেয়েটির নাম ইভা। ইভা একসময় অভিনয় করত। ইউনিটের সবাই অনেক সাহায্য করেছিল। সবার সহযোগিতায় ভালোভাবে কাজটি শেষ করেছিলাম।
কিন্তু এই নাটক নির্ধারিত সময়ে বিটিভিতে প্রচার হয়নি। আমার একটু মন খারাপ হলো। পরে আমার বোন তমালিকা বাসায় এসে বলল, ‘একটা নাটক বানাবি সেটা পরের মাসে বিটিভিতে প্রচার হবে।’ পরে আমার বাসার বুয়ার গল্প নিয়ে ‘এক জীবনে’ নাটকটি নির্মাণ করি। অ্যাডমিডিয়ার জায়েদান রাব্বী নাটকটি নির্মাণের সুযোগ দিয়েছিলেন। নাটকটিতে অভিনয় করেন শাহেদ, তমালিকা, তাজিন এবং অরুণাভো অঞ্জনসহ আরো অনেকে। ২০০১ সালে ২৮ অক্টোবর নাটকটি বিটিভিতে প্রচার হয়। প্রচারের পর আমি অনেক সাড়া পেয়েছি। রাত দুটো পর্যন্ত সবার ফোন এসেছিল। বিপাশার ফোন পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলাম। ও অনেক খুঁতখুঁতে।
যখন ও বলল, ‘নাটকের স্টোরি, প্রোডাকশন, মেকিং দারুণ হয়েছে’, তখন মনে একটু আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।
নাটকটি যখন প্রচার হয় তখন আমার স্বামী অরুণ চৌধুরী ব্যাংককে ছিল। সে ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, ‘তুমি নাকি একটা নাটক বানিয়েছো সেটা নাকি খুব সুন্দর হয়েছে! নাটকটা দেখাও তো। আমি যেখানে যাচ্ছি সবাই বলছে তোমার বউ একটা ভালো নাটক বানিয়েছে’। পরে আমি তাকে নাটকটা দেখাই। দেখার পর ও মুগ্ধ হয়েছিল।
‘শেষ বেলায়’ নাটকটি সম্পর্কে চয়নিকা চৌধুরী বলেন, নাটকটি পাঁচ বছর পর বিটিভিতে প্রচার হয়েছিল। এ জন্য আমি আমার বোন তমালিকা, মুজিবর রহমান, জায়েদান রাব্বী এবং মাহফুজ আহমেদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।
ভালোবাসার নাটক বানিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন চয়নিকা চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে চয়নিকা বলেন, ভালোবাসার নাটক বানানো খুব কঠিন। অভিনয় করাও কঠিন। শুধু ফুল দিলে আর আই লাভ ইউ বললে ভালোবাসার নাটক বানানো হয় না। ২০০১ সালে আমি যখন নাটকে ফুল, বৃষ্টি, মোমবাতি, কেক রাখি তখন অনেকে এটার সমালোচনা করেছিলেন। আবার অনেকে খুব পছন্দও করেছিলেন। যাঁরা সমোলোচনা করেছিলেন তাঁরা এখন নাটকে বৃষ্টি, ফুল, কেক ব্যবহার করেন যা দেখে আমার নিজেরও এখন ভালো লাগে। ভালোবাসা ছাড়া দুনিয়ায় কিছু সম্ভব না। আমার নাটকে দেশপ্রেম, নারী, প্রেম-ভালোবাসা, পরিবার, বাবা দিবস, মা দিবস সব রকম গল্পের চিত্র দেখানো হয়।
নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক ভালো-খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে পরিচালক চয়নিকা চৌধুরীর। এমন অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তিনি, ২০০৫ সালে আমি যখন ‘দুই বোন’ নাটকটা বানাই, তার কিছুদিন আগে আমাকে শিডিউল দিয়ে মাহফুজ আহমেদ হুমায়ূন আহমেদের নাটকের জন্য সুইজারল্যান্ডে যান। যাওয়ার আগে মাহফুজ আহমেদ আমাকে বলেন, ‘তোমার কাছে অনেক ফোন আসবে। অনেকে বলবে আমি আর ফিরে আসব না। তুমি সেগুলো শুনবে না। আমি ঠিকই চলে আসব।’ তারপর বিপাশা আমাকে বলল, ও যেহেতু বলেছে তাহলে ঠিকেই ফিরে আসবে। পরে ঠিক সময়ে এয়ারপোর্ট থেকে নেমে বাসায় না গিয়ে সরাসরি মাহফুজ আমার সেটে এসেছিল। ওকে সবাই সেখানে অনুরোধ করেছিল আর একটা নাটকের শুটিং করে যেতে। কিন্তু মাহফুজ ঠিকই আমার কথা রেখেছিল। নাটকটিতে দুই বোনের চরিত্রে বিপাশা ও তারিন অভিনয় করেছিল।
চয়নিকা চৌধুরী আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বললেন, গত মাসে টরেন্টোতে কাজ করতে গিয়েছিলাম। সেখানে ‘স্পর্শ’ নামের একটি নাটক বানাতে গিয়ে দেখি কাজে অনেক বাধা। সিনিয়র শিল্পীরা সবাই ঠিক আছে কিন্তু জুনিয়রদের মধ্যে কেউ ঠিক নেই। নাটকের শুটিংয়ের একদিন আগে সবাই বলল তারা কাজটা করবে না। এর কারণ কেউ কেউ ফোন করে তাদের নিষেধ করেছে কাজটি করতে। এই কথা শুনে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ভালো কাজের পেছনে ঈশ্বর ও কিছু ভালো মানুষ থাকেন। ঈশ্বর ভালো মানুষদের সঙ্গে সব সময় অনেক সৎ থাকেন। পরে আমি নাটকটি ঠিকই নির্মাণ করি। খুরশিদ শাম্মী, শাওলী, ফারহানা পল্লব, স্বর্ণালী রায়, নাদিম ইকবাল, রিজওয়ান রহমান, ম্যাক আজাদ, আহমেদ হোসেনসহ সবাই নাটকটি বানাতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। নাদিম ইকবাল ক্যামেরা চালিয়েছিলেন। আমি একটা কথাই বলব, খারাপ মানুষরা ভালো কাজে বাধা দিতে পারে কিন্তু কাজটাকে বন্ধ করতে পারে না।
আগামীকাল বিশ্ব মা দিবস। মা দিবস উপলক্ষে চয়নিকা চৌধুরী তাঁর মাকে বই, ফুল, কার্ড উপহার দিতে পছন্দ করেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়ে- অনন্য ও অনুলেখার কাছ থেকেও উপহার পান।
নিজের পরিবার সম্পর্কে চয়নিকা চৌধুরী জানালেন, ‘ভালো কাজ করার জন্য আমার মন সব সময় অনেক হাহাকার করে। বিয়ের পর আমি আট বছর গৃহিণি ছিলাম। এখনো আমি ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠি। রান্না-বান্না করি। পরিবারের দেখাশোনা করি। আমার ভালো লাগে। আমি অনেক উপভোগ করি। আমার স্বামী অরুণ চৌধুরী আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন নাটক নির্মাণের জন্য। আমার ছেলেমেয়েরাও বেশ গর্বিত আমাকে নিয়ে। আমার ননদ রুপশ্রী চৌধুরী ও শ্বশুরবাড়ির সবাই আমাকে অনেক সমর্থন দিয়েছেন। আর আমার বাবা-মা সবসময় আমার পাশে ছিলেন। অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। আমার ছেলে যখন স্কুলে পড়ত তখন তার শিক্ষকরা তাকে বলত, ‘তুমি চয়নিকা চৌধুরীর ছেলে?’, তখন ও খুব খুশি হতো।
২০০৪ সাল থেকে মা দিবসের জন্য নাটক বানান চয়ানিকা চৌধুরী। তিন বছর ধরে এনটিভির মা দিবসের বিশেষ নাটক তিনি বানাচ্ছেন। এবারও নির্মাণ করেছেন বিশেষ নাটক ‘আপন কথা’।
চয়নিকা চৌধুরী বলেন, মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই। মায়ের ভালোবাসার কাছে সব ভালোবাসা তুচ্ছ।
চয়নিকা চৌধুরীর পছন্দের পরিচালকদের তালিকায় আছেন আবুল হায়াত, আফসানা মিমি ও এ সময়ের শিহাব শাহীন এবং অরুণ চৌধুরী। মাহফুজ আহমেদের নাট্যপরিচালনা সবচেয়ে ভালো লাগে গুণী এই পরিচালকের। নতুনদের মধ্যে সকাল আহমেদ, বান্নাহ্ ও আশিকের কাজও অনেক পছন্দ করেন তিনি।
শুধু নাটক নয়, ছবিও নির্মাণ করতে যাচ্ছেন চয়নিকা চৌধুরী। ছবির নামও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। জুলফিকার রাসেলের লেখায় ছবির নাম ‘ভালোবেসেই মরি’।
সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছর ছবির কাজ শুরু করবেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে চয়নিকা বলেন, আমার ছবিতে নাচগান, মারামারি ও পরিবারের গল্প থাকবে। আমি মেধাবী পরিচালক না কিন্তু আমি পরিশ্রমী। আমি মনে মনে ছবির নায়ক-নায়িকা ঠিক করে রেখেছি। সময় হলে সবাইকে জানাব। শুধু আমার দর্শকদের এতটুকু বলব, আমি সবার জন্য পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাব কিন্তু কোনো টেলিফিল্ম নয়। সবাই আমার জন্য প্রার্থনা করবেন।