সাক্ষাৎকার
‘রমিজের আয়না’ ছিল শিহাব শাহীনের টার্নিং পয়েন্ট
দেশের জনপ্রিয় পরিচালকদের একজন শিহাব শাহীন। টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালনা করে তারকাখ্যাতি পেলেও তিনি প্রথম মঞ্চনাটক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, অভিনয় করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। এনটিভি অনলাইনকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নিজের পরিচালক জীবনের শুরুর গল্প থেকে অনেক বিষয়ে আলাপ করেছেন শিহাব শাহীন ।
এনটিভি অনলাইন : নাট্য পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
শিহাব শাহীন : টিভি নাটক পরিচালনার আগে আমি প্রথম মঞ্চনাটক নির্দেশনা দিয়েছিলাম। এটা ১৯৯৩ সালের কথা। নাটকের নাম ছিল ‘তীত পটলা।’ আমি নিজেই নাটকটি লিখেছিলাম। নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন নাসির উদ্দীন সাইমুম, দিপু, লাকী, মিতুসহ অনেকেই। ফেনী জেলার মফস্বল এলাকায় মঞ্চনাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন আমরা করেছিলাম। ফেনী শহরের এটা অনেক হিট নাটক ছিল। নাটকটি কমেডি ছিল। ফেনীর পরে আরো বেশ কিছু জেলায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল।
এনটিভি অনলাইন : আপনি নিজেও তো মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছিলেন?
শিহাব শাহীন : কিছু মঞ্চনাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছি। কিন্তু অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আমার খুব ভালো নয়। নাটকে অভিনয়ের আগে আমি টয়লেটে দৌড় দিতাম। নাটক শুরু হওয়ার পরও ভয়ে টয়েলেটে গিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। সবাই শাহীন, শাহীন বলে ডাকার পর টয়লেট থেকে বের হতাম।
এনটিভি অনলাইন : মঞ্চনাটক নির্দেশনা দেওয়ার পর টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন?
শিহাব শাহীন : ১৯৯৫ সালে ঢাকায় এসে ‘দেশ’ নাট্যদলের সঙ্গে আমি যুক্ত হই। সেখানে মঞ্চনাটকে বেশ কিছু কাজ করি। অভিনয়ও করেছিলাম। এখনো আমি দেশ নাটকের সদস্য। কিন্তু আগের মতো কাজ করা আর হয় না। এরপর ফিল্ম পরিচালনার ওপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় মাসের একটি কোর্স করেছিলাম আমি। কিন্তু প্রথমে চলচ্চিত্র না বানিয়ে নাটক নির্মাণ শুরু করি। ২০০১ সালে ‘ঘূর্ণি’ নামে একটি নাটক নির্মাণ করি। রোমান্টিক ও সায়েন্সফিকশন ধরনের নাটকটির গল্প ছিল। নাটকটি এনটিভিতে প্রচারিত হয়। নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন লিটু আনাম, বন্যা মির্জা প্রমুখ।
এনটিভি অনলাইন : মঞ্চনাটক থেকে বেরিয়ে এসে টেলিভিশন নাটক পরিচালনা করা আপনার কাছে কতখানি চ্যালেঞ্জিং ছিল?
শিহাব শাহীন : অবশ্যই অনেকখানি চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে টানা ১৬ দিন ধরে ‘ঘূর্ণি’ নাটকটির শুটিং আমি করেছিলাম। নাটকটি সম্পাদনা করেছিলেন ইকবাল চৌধুরী জুয়েল। জুয়েল ভাই এখন অনেক বিখ্যাত। যা হোক নাটকটির শুটিংয়ের সময় আমি একটু নার্ভাস ছিলাম। এখন নাটক শুরু করার আগেই বুঝতে পারি এর ফলাফল কী হতে পারে। কিন্তু প্রথম দিকে এটা কোনোভাবেই বুঝতে পারতাম না। অন্যদিকে, মঞ্চনাটকের সেট একটাই থাকে। স্পেসও কম। জমি, মাঠ, সব লোকেশন অভিনয়শিল্পী অভিনয় করেই দেখান। টিভি নাটকের চিত্রনাট্যে যে দৃশ্যের কথা থাকে সেটাই দেখাতে হয়। ক্যামেরা সম্পর্কে জানতে হয়।
এনটিভি অনলাইন : ‘ঘূর্ণি’ নাটকটি প্রচারের পর কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?
শিহাব শাহীন : তখন তো আর ফেসবুক ছিল না। সাধারণ দর্শকের অনুভূতি অতটা জানতে পারিনি। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, আত্মীয়স্বজনরা অনেক প্রশংসা করেছিলেন। তবে নাটকের প্রমো থেকে অনেক বেশি সাড়া পেয়েছিলাম। কারণ তখন এনটিভি নতুন চ্যানেল। প্রতিটি অনুষ্ঠানের প্রমো এনটিভি অনেকবার করে দিত। আমার নাটকটির প্রমো দিনে ১০০ বার করে যেত। প্রমোতে বড় করে লেখা ছিল ‘পরিচালনায় শিহাব শাহীন’। এ ছাড়া নাটকটি এনটিভিতে প্রচারিত দ্বিতীয় নাটক। তাই আমি নিজেও উচ্ছ্বসিত ছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : টেলিভিশন নাটকে আপনার টার্নিং পয়েন্ট কী ছিল?
শিহাব শাহীন : এনটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক ‘রমিজের আয়না’ ছিল আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। নাটকটি যখন প্রচার হয় তখন সম্ভবত এনটিভি প্রতিটি ঘরের মানুষেই দেখতেন। তবে নাটকটি প্রচারের আগে অধিকাংশ মানুষই বলেছেন নাটকটিতে অফিশিয়াল ব্যাপার বেশি রয়েছে, তাই এটা চলবে না। কিন্তু প্রচারের পর দেখা গেল নাটকটি দর্শকপ্রিয় হয়েছে। তখন আমি যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, সেই বাড়িওয়ালা নাটকটি অনেক পছন্দ করেছিলেন। প্রতিটি পর্ব দেখে তিনি তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। আর আমাকে রমিজের আয়নার পরিচালক বলে ডাকতেন তিনি। আমার মনে পড়ে নাটকটির ৩০ কিংবা ৪০ পর্ব প্রচারের পরে কোনো এক সংলাপে একটা মোবাইল নম্বর দিতে হয়েছিল। আমি আমার আসল মোবাইল নম্বরটা দিয়েছিলাম। নাটকটির ওই পর্ব প্রচারের পর ক্রমাগত দর্শকের ফোন এসেছিল। সম্ভবত টানা ২০ দিন আমি শুধু দর্শকের ফোন রিসিভ করেছি। দর্শকের ভালোবাসা সরাসরি পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম। নাটকের অভিনেতা প্রাণকে তখন রমিজ বলেই সবাই ডাকতেন।
এনটিভি অনলাইন : এখন ‘রমিজের আয়নার’ মতো জনপ্রিয় সিরিয়াল কেন নির্মিত হচ্ছে না বলে আপনি মনে করেন?
শিহাব শাহীন : তখন আমরা নাটকের প্রতি পর্বের শুটিংয়ের জন্য ৯০ হাজার টাকা পেতাম। অভিনেতাদের পারিশ্রমিক ছিল তিন হাজার টাকা। নাটকের বাজেট ছিল বেশি। এখন নাটকের বাজেট আগের মতোই আছে কিন্তু অভিনেতাদের পারিশ্রমিক বেড়েছে ১০ গুণ। কিন্তু অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিক অনুযায়ী নাটকের বাজেট কিন্তু বৃদ্ধি পায়নি। এখন অভিনয়শিল্পীরা যখন-তখন নিজেরা পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দেন। এটা হওয়ার পেছনে আর একটি কারণ হলো, কিছু তরুণ নাট্য পরিচালক আছেন যাঁরা বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে শিল্পী নিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে বেশির ভাগ পরিচালক ক্যামেরার কাজও ঠিকমতো জানেন না। যা হোক এখন অনেক চ্যানেল, দর্শকও বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় শিল্পী সংকট। তাঁর চেয়েও বড় সংকট ভালো মানের চিত্রনাট্যকার নেই। আমি বলব তরুণদের মধ্যে ভালো চিত্রনাট্যকার একেবারে নেই। আমাদের এসবের সীমাবদ্ধতা এখন অনেক বেশি। তাই এখন হয়তো অনেক নাটক নির্মাণ হচ্ছে কিন্তু মানসম্মত কাজ খুব হচ্ছে কম। নাটক কিংবা ফিল্মের ভাষা তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বেশির ভাগ দর্শক নিজের স্বপ্ন পর্দায় দেখতে চায়। নিজের কষ্টও খুঁজতে চায়। দুটো কাজই পর্দায় ফুটিয়ে তোলা চালেঞ্জিং।
এনটিভি অনলাইন : প্রেম-ভালোবাসার নাটক আপনি বেশি নির্মাণ করেছেন। এর কারণ কী?
শিহাব শাহীন : ‘ভালোবাসি তাই’ নাটকটি নির্মাণের পর দেখলাম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল নাটকটি। নাটকটির ডিভিডিও প্রচুর বিক্রি হলো। এরপর ‘ভালোবাসি তাই, ভালোবেসে যাই’ নাটকটি নির্মাণ করলাম। এই নাটকের ফিডব্যাকও প্রচুর। দর্শকরা ভালোবাসার নাটক দেখতে বেশি পছন্দ করছেন। এর পর থেকে মূলত রোমান্টিক নাটক আমি নির্মাণ করেই চলছি। এটা দর্শকের ভালোবাসার কারণেই।
এনটিভি অনলাইন : এখন পর্যন্ত একশর ওপরে নাটক পরিচালনা করেছেন। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ নামের একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন। ক্যারিয়ারে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন কি?
শিহাব শাহীন : শুরুর দিকে একদম বাধা ছিল না। মনে হয়েছিল এসেই সবার হৃদয় জয় করতে পেয়েছিলাম। আমাকে চ্যানেলে চ্যানেলে দৌড়াতেও হয়নি। আমি চলচ্চিত্র নির্মাণে অনেক বাধা পেয়েছি। চলচ্চিত্র বানানোর ইচ্ছা ছিল অনেক আগেই। নানা কারণে এটা হয়নি। তখন এফডিসির পরিচালকরা টেলিভিশন নির্মাতাদের মূল্যায়ন করেননি। আমরাও তাঁদের ঠিকমতো মূল্যায়ন করতে পারিনি। এ জন্য কোথায় যেন একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। অনেকে আমাকে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু আমি রাজি হতে পারিনি। কারণ তাঁরা পছন্দমতো শিল্পী নির্বাচনসহ অনেক কিছু নিজের মতো করে চাইতেন। কিন্তু আমার পক্ষে সেগুলো সম্ভব ছিল না। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ নির্মাণের আগেও আমি আর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভেবেছিলাম। যেটা এখনো করতে পারিনি। যা হোক ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবির আগে ইরেশ যাকেরের সঙ্গে আমার মিটিং হয়েছিল। ইরেশ অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন। এমনকি ‘ভালোবাসি তাই’ নাটকটি বানানোর সময়ও ইরেশ খুব অনুপ্রাণিত করেছিলেন আমাকে।
এনটিভি অনলাইন : ইরেশ যাকের আপনার অনেক সফল কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কিছু বলুন।
শিহাব শাহীন : ইরেশ যাকের অনেক ভদ্র-নম্র একজন মানুষ। সময়জ্ঞান ভালো। এ ছাড়া ইরেশ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। এটা অনেকেই কিন্তু জানেন না। আর অভিনেতা হিসেবে ইরেশ অসাধারণ।
এনটিভি অনলাইন : একসময় অভিনয় করেছেন, নাটক লিখছেন ও পরিচালনাও করছেন। আসলে আপনি কী হতে চেয়েছিলেন?
শিহাব শাহীন : আমাকে অভিনয় কখনো টানেনি। লেখালেখিতে ছোটবেলা থেকেই অনেক আগ্রহ ছিল। ভবিষ্যতে উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। পরিচালনার প্রতি আমার প্রেম-ভালোবাসা অনেক গভীর। আমি আসলে পরিচালকই হতে চেয়েছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : একজন শিহাব শাহীন হয়ে ওঠার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
শিহাব শাহীন : আমার মায়ের। মা এখন বেঁচে নেই। আমার জীবনে মায়ের অবদানে অসীম। আমার পরিচালনায় প্রতিটি নাটক মা অনেক মনোযোগের সঙ্গে দেখতেন।
এনটিভি অনলাইন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শিহাব শাহীন : বছরে দুটো সিনেমা ও একটি ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করার চেষ্টা করব। এখন সেভাবেই পরিকল্পনা করছি।