খুব গাছে চড়তাম : পপি

পুরো নাম সাদিকা পারভিন পপি। তবে বাংলাদেশের মানুষ একনামেই তাঁকে চেনেন-পপি। তিনি বাংলাদেশের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও মডেল। ১৯৯৭ সালে ‘কুলি’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখেন পপি। এ পর্যন্ত তিনি তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ‘কারাগার’ (২০০৩), ‘মেঘের কোলে রোদ’ (২০০৮) ও ‘গঙ্গাযাত্রা’ (২০০৯)-তিন চলচ্চিত্রেই শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
সম্প্রতি পপি অনেক ব্যস্ততার মাঝেও কথা বলেছেন এনটিভির সঙ্গে। এ সময় তিনি অকপটেই বলেছেন ছোটবেলার কথা, বন্ধুদের কথা আর দুরন্ত কৈশোরের কথা। সেই আলাপচারিতার আকর্ষণীয় অংশ এখানে দেওয়া হচ্ছে পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন: একটু ভিন্ন রকম প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। শুনেছি নায়িকাদের না কি বন্ধু থাকে না। আপনারও কি বন্ধু নেই?
উত্তর : দেখুন ছোটবেলার সময়টাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ওই সময়কার বন্ধুরাই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। এর বাইরে আমার নতুন বন্ধু খুব কম। ছোটবেলায় যাদের সাথে সময় কাটিয়েছি, তারাই আমার প্রকৃত বন্ধু। কাজের ক্ষেত্রেও অনেক সময় বন্ধুত্ব হয়েছে তবে সেটার পরিমাণ খুব বেশি না। ছোটবেলার বন্ধুদের অনেক মিস্ করি। এখনো সময় পেলে তাদের ফোন করি, ডেকে আনি, এমনকি আমি নিজেই ছুটে যাই। এখনো তাদের সাথে আড্ডাটা অনেক উপভোগ করি।
প্রশ্ন : আপনার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?
উত্তর : আমি ছোটবেলা কাটিয়েছি খুলনায় দাদাবাড়িতে। আমাদের বাড়িটা হচ্ছে কয়েক বিঘার ওপর। পুকুর আছে তিনটা। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। চাচা-চাচি, কাজিনসহ অনেক ভাইবোন একসাথে বেড়ে উঠেছি। ছয় ভাইবোনের মধ্য আমিই বড়। ভাইবোন আর কাজিনদের সাথেই সময় কাটত। স্কুলের যে বন্ধুরা ছিল তারাও খেলার সময় আমাদের বাড়িতে চলে আসত। এ ছাড়া বাইরের ছেলেমেয়েদের আমাদের ওখানে আসার সুযোগ ছিল না।
প্রশ্ন : কিশোরবেলায় কী করতে ভালো লাগত বেশি?
উত্তর : আমার দাদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। প্রচুর গাছ লাগানোর অভ্যাস ছিল তাঁর। ফল কিংবা ফুল কোনোটারই অভাব ছিল না বাড়িতে। সব মৌসুমের ফলই ধরত আমাদের বাগানে। আবার যখন যে সময়ে যে ফুল ফোটে, তাও আমাদের বাগানে ফুটে থাকত। মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাকত প্রচুর গাছ। আমিও দাদির সাথে প্রচুর গাছ লাগিয়েছি, পরিচর্যা করেছি। চোখের সামনে বেড়ে ওঠা ফুলগাছে যখন ফুল ফুটত, দেখে কী যে আনন্দ হতো তা বলে বোঝানো যাবে না। গাছের পরিচর্যা করতে আমার বেশি ভালো লাগত।
একটা মজার ঘটনা বলি, প্রতিদিন দাদি আর আমার ফুল তোলার প্রতিযোগিতা হতো। দাদি যেহেতু নামাজ পড়তেন তাই তিনি আজানের সময় ভোরবেলায় বিছানা ছাড়তেন। আমি ঘুম থেকে উঠেই সোজা দৌড় দিতাম বাগানে। প্রায়ই দেখতাম আমি দাদির আগে এসেছি বাগানে। তখন নিজেকের বিজয়ী মনে হতো। ফুল তুলতে তুলতে বেলা হয়ে যেত। আবার মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হতো। বেলা করে উঠলে মন খারাপ হয়ে যেত কারণ ততক্ষণে ফুলগুলো আর তাজা থাকত না। ভোরবেলা শিউলি ফুল কুড়াতে অনেক মজা লাগত। শিউলি ফুলের গন্ধ এখনো নাকে লেগে আছে।
প্রশ্ন : গাছে চড়েছেন কখনো?
উত্তর : আমি খুব গাছে চড়তাম, অনেকবার গাছ থেকে পড়েছি। আমের সময় হলে সারা দিন আম গাছেই থাকতাম। আমি ছিলাম আমাদের সমবয়সীদের মধ্যে দলনেতা আর তাই সবাই এসে অপেক্ষা করত কখন আমি বাসা থেকে বেরুবো। বাসায় কেউ আমাকে খুঁজে না পেলে বুঝে নিত আমি আমগাছে। আম পাড়তে গিয়ে অনেকবার পড়ে গিয়ে ব্যথাও পেয়েছি।
প্রশ্ন : বাড়িতে তো তিনটা পুকুর ছিল। মাছ মেরেছেন কখনো?
উত্তর : মাছ মারতে খুব ভালো লাগত। আমাদের যেহেতু যৌথ পরিবার। বাড়িটা পাঁচ ছয় বিঘা জমির ওপর, অনেক বড় বাড়ি। পুকুর আছে তিনটা। বাবা, চাচাদের বড়শি দিয়ে মাছ মারাটা ছিল দৈনন্দিন কাজের অংশ। আমার উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় দেখে এক ধরনের বিরক্তি লাগলেও একটা মাছ ধরলেই সব ভুলে যেতাম।
প্রশ্ন : চড়ুইভাতি করেছেন ছোটবেলায়?
উত্তর : চড়ুইভাতি তো করতামই, পিকনিকও করতাম! প্রতি সপ্তাহে বনভোজনে রান্না করতাম আমরা, যৌথ পরিবারে থাকার অনেক সুবিধা আছে। চাচাতো ভাইবোন মিলে আমাদের সংখ্যা অনেক হওয়ার কারণে প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন মানেই পিকনিক। ভ্রাম্যমাণ চুলা নিয়ে রান্না করতাম আমরা, কারণ আমাদের এই রান্নার কারণে বাগানের গাছ নষ্ট হয়ে যাবে, গাছের আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা রান্না করতাম আর পালিয়ে বেড়াতাম দাদির কাছ থেকে।
প্রশ্ন : ছোটবেলায় গান করেছেন কখনো?
উত্তর : একদিন মাত্র গান শিখেছিলাম। আমার গান করার খুব ইচ্ছে ছিল ছোটবেলায়। দাদির জন্য ওই বাড়িতে নাচ-গান ছিল নিষেধ। বাবা-মাও রাজি ছিলেন না কিছুতেই। অবশ্য অনেক জেদ করার পর অবশেষে রাজি হলেন তাঁরা। মনের আনন্দে অপেক্ষা করতাম কখন গানের শিক্ষক আসবেন। অবশেষে ম্যাডাম এলেন এবং সংগীত শিক্ষার প্রথম দিনটি পার করলাম। দ্বিতীয় দিন অপেক্ষা করছি ম্যাডাম কখন আসবেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ম্যাডামের খবর নেই। পরে রাতে খবর পেলাম দাদি বিকেল থেকেই লাঠি নিয়ে বসেছিলেন বাড়ির মূল ফটকে। আমার আর গান শেখা হলো না।
প্রশ্ন : গান হয়নি। কিন্তু ছবি আঁকা কিংবা কবিতা আবৃত্তি করতেন?
উত্তর : খুলনার স্থানীয় একটি আর্টস্কুলে ছোটবেলায় ছবি আঁকা শিখেছি, ওটা ছিল আমার সখ। আমাদের বাড়ির পরিবেশটা যেহেতু সবুজে ঘেরা, তাই প্রকৃতি আমাকে অনেক টানত। প্রকৃতির ছবিই বেশি আঁকতাম। যেহেতু সবাই জানে আমি ছবি আঁকি, সেহেতু বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আমার নাম এমনিতেই দেওয়া থাকত। পুরস্কারও পেয়েছি অনেক।
কবিতা আবৃত্তি করতে খুব ভালো লাগত। আমার পরিবারের সদস্যরা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কবিতা শুনত। আমিও মহা উৎসাহ নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতাম। স্কুলের কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় সব সময় আমি প্রথম হতাম। শিক্ষকরা আবৃত্তির প্রশংসা করতেন। তাঁরা বলতেন, আমার আবৃত্তি অনেক ভালো হয়। আমি আসলে কবিতা অনুভব করতে পারতাম, প্রতিটি বাক্যের সাথে মিশে যেতাম। কাজটা করতাম ভালোবাসা থেকে।
প্রশ্ন : তাহলে স্কুলে তো বিখ্যাত ছিলেন আপনি?
উত্তর : মুন্নুজান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে খেলাধুলায় আমি ছিলাম চ্যাম্পিয়ন। সাঁতারে আমার সঙ্গে কেউ পারত না। আমি খুব দ্রুত সাঁতরাতে পারতাম। আমাদের বাড়ির চারপাশে তিনটি পুকুর থাকাতে সারা দিন এমনিতেই সাঁতার কাটা হতো। সাইকেল চালানো, দৌড়ানো, উঁচু লাফ-সব খেলাতেই আমি ছিলাম প্রথম। খেলাধুলার জন্য শিক্ষকরা আমাকে বাড়তি আদর করতেন। কারণ আন্তস্কুল প্রতিযোগিতায় আমি স্কুলের পক্ষ থেকে পুরস্কার নিয়ে আসতাম।
আর আরেকটা জিনিস আমার ভালো লাগত। গার্লস গাইড করা। স্কুলে গার্লস গাইড করার সুবাদে নিয়মতান্ত্রিক জীবনের ধারণা পেয়েছিলাম। যেহেতু আমি খুব দুষ্টু ছিলাম, তাই নিয়মকানুন শেখাটা আমার জন্য জরুরি ছিল। অবশ্য আমাদের পারিবারিক আইন অনেক শক্ত ছিল। তারপরও আমি একটু বেয়াড়াই ছিলাম। গার্লস গাইড থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সামাজিক কোনো সমস্যা তৈরি হলে আমরা গার্লস গাইডের মেয়েরা সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, সহযোগিতা করতাম মানুষকে। যে কোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকার যে কী আনন্দ সেটা বুঝতে পারতাম না স্কুলে গার্লস গাইড না করলে।
প্রশ্ন : ভাষার মাস একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কোনো ঘটনা মনে আছে?
উত্তর : ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে মাটি দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়ে ফুল দিতাম। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের অন্য রকম প্রস্তুতি শুরু হতো। ১৯ তারিখ থেকে শহীদ মিনার বানানোর মূল উপাদান মাটি জোগাড় করতাম। বাঁশের কঞ্চি, গাছের ডাল দিয়ে প্রথমে অবকাঠামো তৈরি করে তার ওপর মাটির প্রলেপ দিতাম। আমরা অনেক সুন্দর করে কারুকাজ করতাম শহীদ মিনারে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের সব কাজ শেষ করতাম। নিজেদের বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করে বিভিন্ন রকমের তোড়া বানিয়ে সারা রাত অপেক্ষা করতাম কখন সকাল হবে। সকালে পরিবারের সবাই মিলে ফুলের তোড়া দিতাম মিনারে। কী যে আনন্দ লাগত!