হতাশা আমাকে জাগিয়ে তোলে : সাদাত হোসাইন
সাদাত হোসাইন। বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি। যখন তরুণদের নিয়ে নানা হতাশার গল্প, আক্ষেপের গল্প, সেই মুহূর্তে ইতিবাচক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন যে কজন তরুণ, তিনি তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি গল্প শোনান চলচ্চিত্রে, লেখায়, ছবিতে। তাঁর সেই গল্পজুড়ে থাকে স্বপ্ন, তাঁর সেই গল্পজুড়ে থাকে সম্ভাবনা। এ বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য সুজ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতার পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। তিনি কথা বলেছেন সেখ ফয়সাল আহমেদের সঙ্গে।
প্রশ্ন : শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতার পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে?
সাদাত হোসাইন : কিছুটা দ্বিধান্বিত। দ্বিধান্বিত এই কারণে যে আমার ধারণা ছিল, আমি ফিল্ম মেকিংয়ের কিছুই জানি না। ইনফ্যাক্ট এখনো সে ধারণাটাই আছে। কিন্তু তারপরও যখন শত শত সিনেমার মধ্য থেকে আমার সিনেমার জন্য আমি বেস্ট ফিল্ম মেকার অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেলাম, তখন দ্বিধান্বিত না হয়ে উপায় কী! তবে হ্যাঁ, এটা একটা অসাধারণ অর্জন। সবচেয়ে বড় কথা, পুরস্কার-স্বীকৃতি সব সময় অনুপ্রেরণা জোগায়। এই পুরস্কার আমার জন্য বিশেষ প্রাপ্তি, বিশেষ অনুপ্রেরণা।
প্রশ্ন : ফিল্ম বানানোর ইচ্ছেটা কখন থেকে?
সাদাত হোসাইন : আসলে আলাদা করে ফিল্ম বানানোর ইচ্ছে কখনোই ছিল না আমার। আমার ইচ্ছে যেটি ছিল বা আছে, সেটি হলো গল্প বলা। আমি সব সময়ই গল্প বলতে চেয়েছি। আমার মনে হয়, আমার ভেতরে অসংখ্য গল্প। এই গল্পগুলো আমি মানুষকে বলতে চাই। এই গল্পগুলো আমি অনেক মানুষকে শোনাতে চাই। এখন আপনি অনেক মানুষকে গল্প কীভাবে শোনাবেন? বিস্তৃত পরিসরে গল্প শোনাতে বা বলতে হলে একটা মাধ্যম দরকার। সেই মাধ্যম কী? আমার কাছে সেই মাধ্যম হলো লেখা, ছবি, চলচ্চিত্র। আমার মনে হলো, এ তিনটি মাধ্যমেই আমি হয়তো গল্প বলতে সক্ষম। প্রথমে এলো আলোকচিত্র, তার পর লেখা, তার পর সিনেমা। আসলে গল্প বলার এই ইচ্ছে থেকেই আমি সিনেমায় এসেছি।
প্রশ্ন : আপনার লেখা প্রসঙ্গে আসি। প্রায় সব পত্রপত্রিকাতেই এসেছে, গত বইমেলায় আপনার বই ‘অন্দরমহল’ ছিল পুরো বইমেলারই বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায়। এবং ‘অন্দরমহল’ প্রায় সাড়ে চারশ পৃষ্ঠার বিশাল একটি বই। একজন তরুণ লেখক হিসেবে এই যে এত বৃহৎ পরিসরে বই লেখা এবং সেটির পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া, রহস্যটা কোথায়?
সাদাত হোসাইন : রহস্যটা সম্ভবত ওই গল্পেই। আমি সব সময়ই সহজ-সাধারণ করে জীবনের গল্প বলতে চেয়েছি। ‘অন্দরমহল’ একটি সুবিশাল উপন্যাস এবং আমার আশঙ্কা ছিল যে একজন তরুণ লেখকের এত বড় উপন্যাস কেউ পাঁচশ টাকারও বেশি মূল্য দিয়ে কিনবে কি না! কিন্তু পাঠক কিনেছেন। কেবল বইমেলাতেই এটির পাঁচটি মুদ্রণ বেরিয়েছে। এর আগে আমার ‘আরশিনগর’ বইটিও অভাবনীয় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে, পাঠক এই গল্পের চরিত্রগুলোতে নিজেদের খুঁজে পেতে চায়। নিজেদের গল্প পড়তে চায়। মানুষ কখন কোন সিনেমা দেখে বা বই পড়ে কাঁদে বা হাসে? যখন সেই সিনেমা বা বইয়ের গল্প তাকে স্পর্শ করে। এই স্পর্শ করাটা খুব জরুরি। এখন অবধি মনে হচ্ছে আমার গল্পগুলো, গল্পের চরিত্র কিংবা বর্ণনার ঢং হয়তো পাঠকের ভালো লেগেছে। পাঠককে স্পর্শ করতে পেরেছে। হয়তো এটিই রহস্য। আসলে আলাদা করে কখনোই এসব ভাবিনি।
প্রশ্ন : এই যে লেখক হয়ে ওঠা, নির্মাতা হয়ে ওঠা। অনুপ্রেরণাটা কার?
সাদাত হোসাইন : সেই অর্থে আমাকে কেউ অনুপ্রেরণা দেননি। আমি প্রচণ্ড কষ্ট করে বেড়ে ওঠা মানুষ। প্রচণ্ড দারিদ্র্য ছিল, প্রচণ্ড অর্থাভাব ছিল, ফলে আমার পরিবার থেকে লেখা বা ফিল্ম মেকিংয়ের স্বপ্ন দেখাটা ছিল অসম্ভব একটা বিষয়। আমার মা-বাবাও কখনো চাইতেন না যে আমি এসব করি। তাঁদের ভাবনাটাও তাঁদের জায়গা থেকে খুব স্বাভাবিকই ছিল। তাঁরা চাইতেন, আমি যেন একটা সরকারি চাকরি বা নিশ্চিত অর্থ সংস্থানের কোনো উপায় খুঁজি। কিন্তু আমার ভেতরে গল্প বলার একটা তীব্র খিদে সব সময়ই ছিল। এই খিদে আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, যা আমি অনেক দেরি করেই টের পেয়েছি। তবে এই যে লেখক হয়ে ওঠার পেছনে কিছু মানুষ নানাভাবেই ভূমিকা রেখেছেন। খুব কাছের ছোট ভাই, লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান, বিখ্যাত আলোকচিত্রী পিউ ভাই। আর আমার প্রথম বই, যেটি মূলত আজকের ঔপন্যাসিক সাদাতের পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসেছে, সেই প্রথম বইটির পেছনে অসাধারণ ভূমিকা ছিল সন্দীপন বসু মুন্নার। এই গল্পগুলো খুবই মজার, সময় পেলে কোনো একদিন বিস্তৃত পরিসরে বলা যাবে।
প্রশ্ন : অনেক তরুণ আপনাকে অনুসরণ করে। আপনার গল্প পড়ে, সিনেমা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়, জীবনের কঠিন সময় থেকে উঠে এসে জয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। এভাবে অনুপ্রাণিত করার শক্তি আপনি কোথা থেকে পান?
সাদাত হোসাইন : আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে আমার গল্প বা সিনেমাগুলো কাউকে কাউকে অনুপ্রাণিত করে। এই অনুপ্রাণিত করার বিষয়গুলো কিন্তু সচেতনভাবে আমার ভাবনায় থাকে না। আমি আমার গল্পটা বলি, ভাবনাটা বলি। হয়তো সেই গল্প ও ভাবনাগুলো পাঠক বা দর্শকের কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে ওঠে। আসলে আমার নিজের জীবনের গল্পগুলো প্রচণ্ড যুদ্ধের, হতাশার, দারিদ্র্যের। আমাকে ভয়াবহ প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে উঠে আসতে হয়েছে। প্রচণ্ড হতাশা, দুঃস্বপ্ন, এসব বিষয়ই ছিল তখন আমার কাছে সবচেয়ে বড় সত্যি। কিন্তু আমি সব সময় এই হতাশাকেই অনুপ্রেরণা করার চেষ্টা করেছি। আপনি খানিক আগে জিজ্ঞেস করলেন না যে আমার ইন্সপায়ারেশন কে? আমি বলি, মাই ফ্রাস্ট্রেশন ইজ মাই ইন্সপায়ারেশন। আসলে কোনো কিছু করতে না পেরে যতবার ফ্রাস্ট্রেটেড হই, ঠিক ততবারই নতুন করে জেগে উঠি। আপনি যদি ক্রমাগত সফল হতে থাকেন, তখন আপনার ভেতরে এক ধরনের শিথিলতা চলে আসবে। নির্লিপ্ততা। সফলতার মূল্যটা আপনি তখন পুরোপুরি বুঝবেন না। এ জন্য ব্যর্থতা দরকার। ব্যর্থতা থেকে ফ্রাস্ট্রেশন আসে। আপনি যদি সেই ফ্রাস্ট্রেশনকে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলেই সেটি হয়ে উঠবে আপনার সবচেয়ে বড় ইন্সপায়ারেশন। এ জন্য আমি সব সময় হতাশাকে পছন্দ করি। এই হতাশা আমাকে জাগিয়ে তোলে। মনে হয়ে হতাশ হওয়া যাবে, কিন্তু হতাশ হয়ে পড়ে থাকা যাবে না। কোনোভাবেই হতাশ হয়ে পড়ে থাকা যাবে না। কাজ করতে হবে, চেষ্টাটা করতে হবে। অসম্ভব হলেও করতে হবে। এবং পুরো চেষ্টা দিয়েই করতে হবে। সুতরাং যতক্ষণ অবধি আমি সফল না হই, ততক্ষণ অবধি আমার অস্থির লাগতে থাকে। এই হতাশার অস্থিরতা আমাকে ঘুমাতে দেয় না, শান্তি পেতে দেয় না। শান্তি পেতে হলে আমাকে অবশ্যই চেষ্টাটা করতে হবে, করতেই হবে। অ্যান্ড, ইট রিয়েলি ইন্সপায়ারস মি।
প্রশ্ন : এ মুহূর্তে কী করছেন?
সাদাত হোসাইন : সামনের বইমেলার জন্য নতুন উপন্যাস লিখছি। নাম ‘মানবজনম’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সবকিছু ঠিক থাকলে এই উপন্যাস বের হওয়ার পরপরই এটি নিয়ে একটি একশ পর্বের ধারাবাহিক নাটকের শুটিং শুরু হতে যাচ্ছে। আমিই নির্মাণ করছি। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি বইয়ের অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি পড়েই এ আগ্রহ দেখিয়েছে।
প্রশ্ন : এই যে এত কিছু করছেন, কখনো ক্লান্ত লাগে না?
সাদাত হোসাইন : কিছু না করলেই বরং ক্লান্ত লাগে। অযথা সময় নষ্ট করার মতন ক্লান্তিকর কিছু আর নেই।
প্রশ্ন : ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে কিছু বলুন…
সাদাত হোসাইন : বড় পর্দার জন্য সিনেমা বানাতে চাই। একটু একটু করে প্রস্তুত হচ্ছি। আমার নিজের একটি প্রোডাকশন হাউস আছে। আমরা নানা ধরনের প্রফেশনাল ভিডিও কন্টেন্ট বানাই। এই কাজগুলো করতে গিয়ে প্রতিদিন ভিডিও মেকিংয়ের নানা কিছু শিখছি। এ ছাড়া ধীরে ধীরে একটি সিনেমার স্ক্রিপ্ট করছি। সেই সিনেমার জন্য গানও লিখে ফেলেছি কয়েকটি। আশা করছি, এই স্বপ্নটা সত্যি হবে।
প্রশ্ন : তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
সাদাত হোসাইন : বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্ন দরকার। স্বপ্নবিহীন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তবে স্বপ্নের ফারাক রয়েছে। বার্ধক্য ও শৈশব হচ্ছে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার সময়, আর তারুণ্য হচ্ছে জেগে স্বপ্ন দেখার সময়। কারণ, এ সময়ের স্বপ্নগুলো কেবল স্বপ্ন থাকলে হবে না, এগুলো সত্যি করতে হবে। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলে সেটি সম্ভব নয়।