সূর্যের আলো ছাড়া মানুষ কত অসহায়
বাংলাদেশ-ভারতের মতো দেশে টের না পেলেও শীতপ্রধান দেশে শীতকালে সূর্যের আলোর অভাব শরীর ও মনমেজাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা সে বিষয়ে সাবধান করে দিয়ে স্বাস্থ্যের সুরক্ষার নানা পরামর্শ দেন। আলো ছাড়া জীবন ভাবাই যায় না। স্বাস্থ্যের জন্যও আলো জরুরি। বিশেষ করে যে সব অঞ্চল শীতকালে অন্ধকার থাকে, সেখানকার মানুষ আলোর অভাব হাড়ে হাড়ে টের পান। অন্ধকার এই মাসগুলিতে অনেক মানুষ তথাকথিত ‘উইন্টার ব্লুজ’ , অর্থাৎ মৌসমি বিষণ্ণতায় ভোগেন। আলোর অভাব মন খারাপ করিয়ে দেয়, এমনকি অসুস্থও করতে পারে। শুধু মন নয়, শরীরের উপরও এর প্রভাব পড়ে।
ক্রোনো-বায়োলজিস্ট হিসেবে হেনরিক ওস্টার সেই অবস্থার কারণ খুঁজতে গবেষণা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আলোর অভাব আমাদের শরীরের উপর চাপ সৃষ্টি করে। শারীরিক ক্রিয়ার উপর আলোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। আমাদের কার্যকলাপ ও মনমেজাজ বদলে দিতে পারে। সেই টাইম সিগনাল আমাদের শরীরকে দিনের বিভিন্ন সময় অনুযায়ী প্রস্তুত করে তোলে৷'' তাঁর গবেষণা অনুযায়ী আলো আমাদের শরীরের নিজস্ব ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ করে৷ শরীরের প্রত্যেকটি কোষের মধ্যে সেই ঘড়ি রয়েছে।
সে কারণেই শরীরের অঙ্গগুলির মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় সম্ভব হয়। আলো খুব কম থাকলে কোষের সেই অভ্যন্তরীণ ঘড়িগুলির ছন্দপতন ঘটে। অঙ্গগুলি তখন আর আদর্শভাবে এবং পারস্পরিক সমন্বয় অনুযায়ী কাজ করে না। তার পরিণাম শরীরের শক্তি ও স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই ভালো হয় না৷ হেনরিক ওস্টার মনে করিয়ে দেন, ‘সেই অবস্থা আমাদের অসুস্থ করে তুলতে পারে, বিপাকীয় রোগে ইন্ধন জোগাতে পারে। এমনকি মানসিক রোগ ও কিছু ধরনের ক্যানসারও ত্বরান্বিত করতে পারে৷'' শরীর ও মন-মেজাজের উপর আলোর বড় প্রভাব সম্পর্কে গবেষকরা আরও বেশি ধারণা পাচ্ছেন।
ওস্টার বলেন, ‘আলো শরীরকে সক্রিয় করে তোলে, আমাদের মনমেজাজ ভালো করে, কিছু একটা করার তাগিদও বাড়িয়ে দেয়। মোটকথা আলো আমাদের ক্রিয়া ও যোগাযোগের ক্ষমতার উন্নতি করে৷'' ফলে মানুষ যে আলোর সন্ধান করে, তাতে বিস্ময়ের কারণ নেই। সুন্দর আলোকসজ্জা মনমেজাজ ভালো করে তোলে। তা সত্ত্বেও কৃত্রিম আলো সূর্যের আলোর বিকল্প হতে পারে না। শরীরে আলোর অভাব মেটাতে এবং শরীরের নিজস্ব ঘড়ির স্বাস্থ্যকর ছন্দ নিশ্চিত করতে জোরালো বাতি দিয়ে লাইট থেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে।
সবটাই আমাদের চোখের মাধ্যমে ঘটে। রেটিনা দিনের নীল আলোর প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং সেই তথ্য মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। সেখান থেকে বডি ক্লক নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এভাবে সেই ঘড়ি ছন্দ অনুযায়ী চলে। তখন ‘মেলাটোনিন’ নামের ঘুমের হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। তার বদলে কর্টিসল ও সেরোটোনিন নামের মন ভালো করা হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। ক্লান্তি দূর হয়, মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। থেরাপিতে ব্যবহৃত কৃত্রিম দিনের বাতির কড়া আলো সত্যি ‘উইন্টার ব্লুস' দূর করে। সকালে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ২,৫০০ লাক্স মাত্রার আলোর সামনে কাটালে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
মাত্র দুই সপ্তাহ ধরে আলোর থেরাপি করালেই কাজ হয় এবং বিষণ্ণ মেজাজ দূর হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে ড. এলমার বাটেনব্যার্গ বলেন, ‘খুব কম আলো বিশেষ করে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মধ্যে বিষাদ তরান্বিত করে। অন্যদিকে বেশি আলো মনমেজাজ আরও ভালো করে তুলতে পারে। তখন দিন ও রাতের ছন্দের উন্নতি হয়৷ সেটা শরীরের ইমিউন সিস্টেমের জন্যও ভালো৷ সে কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট আলো অত্যন্ত জরুরি৷'' অবশ্যই স্বাভাবিক দিনের আলো সবচেয়ে ভালো।
শীতকালে সকালে বা দিনের প্রথমার্ধে সেটা পাওয়া যায়। একমাত্র এভাবেই শরীর ত্বকের মাধ্যমে ভিটামিন ডি সৃষ্টি করতে পারে। হাড়গোড় ও দাঁত মজবুত রাখতে এবং শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেমের জন্য সেটা আমাদের প্রয়োজন৷ ড. বাটেনব্যার্গ বলেন, ‘ভিটামিন ডি হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ভিটামিন ডি-র অভাব ঘটলে অস্টিওপরোসিস এবং হাড় ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায়।''
শীতকালে যখনই সম্ভব দিনের আলো কাজে লাগানো ও উপভোগ করা উচিত।