ডায়াবেটিসে কিডনি রোগ হলে কী করবেন?
ডায়াবেটিস হলে কিডনি রোগ হতে পারে। তবে ঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় না হলেও জটিলতা কিছুটা কমিয়ে আনা যায়। আজ ৯ সেপ্টেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৪৬তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের কিডনি রোগ প্রধান পরামর্শক অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিসে কিডনি রোগের সম্পর্ক কোথায়? ডায়াবেটিস রোগীরা কি বেশি ঝুঁকিপ্রবণ কিডনি রোগের জন্য?
উত্তর : আমরা যদি বলি, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ, যে কারণে কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়, সেই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ, ডায়াবেটিস। দ্বিতীয়, উচ্চ রক্তচাপ। তৃতীয়, গ্লুমারো নেফরাইটিস। এই তিনটি কারণে আমাদের দেশে ৮০ ভাগের বেশি ক্ষেত্রে কিডনি বিকল হয়ে থাকে। সে জন্য ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিডনি রোগের সম্পর্ক অনেক এবং এই রোগীরা এ ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ। বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের শতকরা ৪০ ভাগ লোকের আশঙ্কা আছে ডায়াবেটিস থেকে কিডনি আক্রান্ত হয়ে বিকল হওয়ার।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়, তাহলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে, সে ক্ষেত্রেও কি তার কিডনির সমস্যা হতে পারে?urgentPhoto
উত্তর : যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে কিডনির সমস্যা একেবারেই হবে না, এটা বলা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে অন্যান্য জটিলতা যেমন অনেকাংশে কমে যায়, তেমনি কিডনির ক্ষেত্রেও ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সমস্যা কমিয়ে আনা যায়।
আবার দেখা যায়, ডায়াবেটিস থেকে যার কিডনির সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে, তার যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে কিডনি বিকল হওয়া ধীরগতির হয়। যে বিকল হয়তো ১৫ বছর আগে হতো, সেটাকে ১৫ বছর পিছিয়ে নেওয়া যায়।
সে জন্য যদি ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়, এটা কেবল কিডনি রোগকে প্রতিরোধ করবে তা-ই নয়, শরীরের ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত যত জটিলতা হতে পারে, সবই নিয়ন্ত্রণ করবে।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস রোগী রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার হয়তো চেষ্টা করছেন। তবে এর মধ্যেই কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে, এটা কীভাবে বুঝবেন?
উত্তর : ডায়াবেটিসের প্রথম দিকে তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। আর ডায়াবেটিসের জন্য বা উচ্চ রক্তচাপের জন্য যখন কিডনি রোগ হয়, তাদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ নষ্ট হওয়ার আগে কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না। সে জন্য ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি রোগ হচ্ছে কি না, সেটা বোঝার জন্য সামান্য কিছু পরীক্ষা রয়েছে। সেই পরীক্ষাগুলো করে দেখতে হবে। সেটা হলো, যাদের টাইপ-টু ডায়াবেটিস আছে, তাদের যখন থেকে রোগ ধরা পড়বে, তখন তার প্রস্রাবে মাইক্রোঅ্যালবুমিন পরীক্ষা করতে হবে। আরেকটি হলো রক্তে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা। রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামক একটা উপাদান রয়েছে, এটা পরীক্ষা করলে জানা যায় ১০০ ভাগের ভেতর কিডনি কতভাগ কাজ করছে। এই দুটো পরীক্ষা করা গেলে বোঝা যাবে তার ডায়াবেটিস থেকে কোনো কিডনি রোগ হচ্ছে কি না।
প্রশ্ন : এটা কত দিন পরপর করা উচিত?
উত্তর : টাইপ-টু ডায়াবেটিস যাদের হয়, এদের ক্ষেত্রে বছরে অন্তত দুবার করে এই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আর যাদের টাইপ-ওয়ান ডায়াবেটিস, যারা শুরু থেকেই ইনসুলিন-নির্ভর, তাদের এটা হতে আরেকটু সময় লাগে। সে জন্য যখন ডায়াবেটিস হলো, তার শুরু থেকে অন্তত পাঁচ বছর পর থেকে বছরে অন্তত দুবার করে পরীক্ষা করতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, টাইপ-টু ডায়াবেটিস লক্ষণ ছাড়াই বহুদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তাই টাইপ-টু ডায়াবেটিস ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পরীক্ষা করতে হবে।
আরো কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় আছে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন বেশি, যারা ধূমপান করে, যাদের কোলেস্টেরল বেশি থাকে, যারা কম হাঁটাচলা করে, যারা কম পানি খায়, যারা ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের অন্যান্য জায়গায় ব্যথার কারণে ওষুধ খায়, দীর্ঘদিন যারা ব্যথার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছে, যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে এবং বংশে যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, এ ছাড়া যাদের বংশে ডায়াবেটিস থেকে কিডনি রোগ হয়েছে—এরা সবাই ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। তাদের বছরে অন্তত তিনবার করে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না এবং ক্রিয়েটিনিন বাড়ছে কি না—এ দুটো পরীক্ষা করা উচিত। এই পরীক্ষা অত্যন্ত কম খরচে করা যায়। রোগ ধরা পড়লে এর চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থাও আছে।
প্রশ্ন : কিডনি বিকল হয়ে গেলে কি কোনো লক্ষণ দেখা দেবে?
উত্তর : যখন বিকল হয়ে যায়, ৭০ থেকে ৮০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়, প্রথমেই দেখা যায়, তাদের প্রস্রাবে বেশি করে অ্যালবুমিন যাচ্ছে। সে জন্য চোখ-মুখ ফুলে যায়। আস্তে আস্তে তার খাওয়ার রুচি কমে যায়। তার পর একসময় বমি বমি ভাব দেখা যায়, বমি শুরু হয়। এর পর শরীরে পানি জমে জমে একসময় বুকে পানি জমে, সে জন্য শ্বাসকষ্ট হয়। তার স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা যায়, তার পায়ে-হাড়ে বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা শুরু হয়। অনেক সময় তার পায়ের বোধশক্তি কমে আসে। এগুলো যখন দেখা দিতে থাকে, তখন আমরা বুঝি তার কিডনি বিকল হচ্ছে। এবং অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক সময় দেখা যায়, রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে বা বিনা কারণে গা চুলকাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, রাতে উঠে বারবার প্রস্রাব করতে হয়। এগুলো প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে করতে পারি কিডনি আক্রান্ত হয়েছে।
প্রশ্ন : যদি প্রাথমিক অবস্থায় ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনি রোগ ধরা পড়ে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা কী? আর যদি কিডনি অনেকটাই বিকল হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে এর পরিণতি কী?
উত্তর : যখন প্রস্রাবে মাইক্রোঅ্যালবুমিন যাচ্ছে—এ সময় যদি ধরা পড়ে, তাহলে প্রেশারের কিছু ওষুধ রয়েছে, সেগুলো দেওয়া হয়। এগুলো দেওয়া হলে রোগী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। পাশাপাশি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যেন ফাস্টিং ব্লাড সুগার ৪ দশমিক ৪ থেকে ৬ দশমিক ৬-এর মধ্যে থাকে। অথবা হিমোগ্লোবিন এওয়নসি যেন ৭ থেকে কম থাকে। এভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে সে দীর্ঘদিন ভালো থাকতে পারে এবং কিডনি বিকল হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
আর যার সমস্যা হয়ে গেছে, অর্থাৎ যার প্রস্রাবে প্রোটিন যাচ্ছে এবং ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাচ্ছে আর ইজিএমআর যদি ৬০-এর নিচে চলে আসে, তখন রোগীর অবস্থান খারাপ হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে যদি চিকিৎসা করা যায়, তাহলে যে গতিতে কিডনি নষ্ট হচ্ছে, একে কমিয়ে আনা যায়। যেটা হয়তো দুই-তিন বছর পরেই ডায়ালাইসিস লাগত, সেটা হয়তো ৫ থেকে ১০ বছর পিছিয়ে নেওয়া যায়। তাই যে অবস্থাতেই ধরা পড়ুক না কেন, চিকিৎসা করতে হবে। চিকিৎসা করলে নিরাময় না হোক, জটিলতা কমিয়ে আনতে পারি। তার জীবনযাপনকে অনেকখানি সহজ করে দেওয়া যেতে পারে।