বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস
বাতের ব্যথা কেন হয়?

আজ ১২ অক্টোবব, বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস। আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা একটি প্রচলিত সমস্যা। এনটিভির ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২১৭২তম পর্বে এ বিষয়ে আজ কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল রিউমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী।
urgentPhoto
প্রশ্ন : আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা একটি প্রচলিত শব্দ। কারো কোমরে, হাঁটুতে, গাঁটে ব্যথা হলে মনে করে বাতের ব্যথা হলো কি না। আসলে বিষয়টি কি এই রকম?
উত্তর : বিষয়টি এই রকমই। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি যদি বলি ব্যথা হচ্ছে, গাঁটে, মাংসপেশিতে, তাহলে এটা বাতের ব্যথা। এগুলোর মধ্যে আরো প্রকারভেদ রয়েছে। মেডিসিনের যে শাখাটি মূলত বাত ব্যথা নিয়ে কাজ করে, তাকে বলে রিউমাটোলজি। বলা হয়, পৃথিবীতে এই রিউমাটোলজি-সংক্রান্ত রোগগুলো ১২০ ধরনের হয়। আর যদি খুব ছোট ছোট বলি, তবে ৬০০-এর ওপরে রোগ আছে এই বিভাগে। একেকটি একেক ধরনের, একেক বয়সের। অনেকেরই ধারণা, বাতজাতীয় রোগ বোধ হয় বয়সকালে হবে, তরুণ বয়সে এই সমস্যা হবে না। এই ধারণা একেবারেই ঠিক নয়; বরং আমরা যদি পরিসংখ্যান দেখি, সব রকমের বাত মিলিয়ে কম বয়সের মানুষেরও এ সমস্যা হয়। রোগগুলো তাঁকে হয়তো বিছানায় ফেলে রাখছে। তাঁকে কাজ করতে দিচ্ছে না। সমাজের ও জাতির অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে। কম বয়সেই বরং বেশি মানুষ এ সমস্যায় ভুগে থাকেন।
প্রশ্ন : কম বয়সে মানে কী? ঝুঁকিপ্রবণ দল কারা?
উত্তর : সব বয়সই ঝুঁকিপ্রবণ আমি বলব। এক, দুই বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৬০, ৭০ বছরেরও বাত হতে পারে।
আমরা যদি বলি, বাত জ্বর বা রিউমেটিক ফিভার, এই রোগগুলো কম বয়সের লোকদের হয়। শিশুদের বেশি হয়। এ রকম আরেকটি শিশুদের রোগ হলো জুবেনাই ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস। গাঁটগুলো ফুলে যায়। প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এ ধরনের বয়সগুলোতে যখন এই রোগও আসে, তখন অনেক ভাবেন এটাও বোধ হয় বাত জ্বর। বাত জ্বরের সঙ্গে এই রোগটির পার্থক্য হলো, বাত জ্বরের ব্যথা সবারই এক থেকে তিন মাসের মধ্যে সেরে যায়। তবে জুবেনাই ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস থেকে যায়। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে এবং রোগীকে বিকলাঙ্গ করে ফেলে। আরেকটি রোগ আছে, স্পনডাইলো আর্থ্রাইটিস। এটাও একদম তরুণ বয়সে হয়। ১৭, ১৮, ২০ বছর বয়স থেকে ৩০-৪০ বছর বয়স পর্যন্ত হয়। পুরুষদের বেশি হয়। এই বয়সে যখন সমাজকে-জাতিকে একটা মানুষের অনেক কিছু দেওয়ার থাকে, তখনই তাদের অকার্যকর করে তোলে রোগটি। স্পনডাইলো আর্থ্রাইটিসের মধ্যে আরো ছোট ছোট কিছু রোগ রয়েছে। যেমন এনকাইলজিং স্পনডিলাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস, রিঅ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস এ রকম অসংখ্য নাম। সোরিয়াসিক আর্থ্রাইটিসের সঙ্গে চর্মরোগের সম্পর্ক রয়েছে। সোরিয়াসিস রোগের সম্পর্ক রয়েছে।
প্রশ্ন : একজন মানুষ এই বাতের ব্যথায় আক্রান্ত হন কেন?
উত্তর : আমাদের শরীরে একটি ইমিউন সিস্টেম আছে। এটা হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, যার দায়িত্ব হচ্ছে শরীরকে পাহারা দেওয়া। বেশির ভাগ এ ধরনের বাতগুলো, যেগুলো বেশ জটিল, যেগুলোর নাম হিসেবে একটি বলি এসএলই; এটা তরুণীদের বেশি হয়। এটিও একটি কঠিন রোগ। আরেকটি রোগ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। এগুলো তরুণ বয়সে বেশি হয়। এগুলো আমাদের ইমিউন পদ্ধতির কারণে হয়।
ইমিউন পদ্ধতির দায়িত্ব হলো বিভিন্ন রোগশোকের আক্রমণ থেকে শরীরকে পাহারা দেওয়া। অথচ এই ইমিউন পদ্ধতিই হঠাৎ করে শরীরের সঙ্গে প্রতারণা করে। শরীরকে কোথায় সুরক্ষা দেবে, তা না করে শরীরের গাঁটগুলোকে আক্রমণ করে বসে।
এভাবে উদাহরণ দিতে পারি, একজন দারোয়ান যদি পাহারা দেওয়ার বদলে নিজেই চুরি শুরু করে, তাহলে কেমন হবে? সেভাবেই আমাদের ইমিউন পদ্ধতি প্রতারণা করে।
প্রশ্ন : এটা করে কেন?
উত্তর : এখন পর্যন্ত চিকিৎসকরা নিশ্চিত হতে পারেননি, কেন এমন হয় কিংবা কার বেলায় হবে বা হবে না। অনেক বিষয় এখন দায়ী করা হয়। যেমন : কিছু কিছু রোগ আছে, পারিবারিকভাবে ১০ শতাংশ, ২০ শতাংশ থাকে। বাবা-মায়ের ছিল, সন্তানদের হওয়ার একটি আশঙ্কা থাকে। হরমোনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে সমস্যা হতে পারে। কিছু কিছু পরিবেশগত কারণকেও দায়ী করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব হয়নি যে এটা এ কারণেই হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাবে।
প্রশ্ন : বাতের ব্যথা বোঝার উপায় কী?
উত্তর : যেকোনো ব্যথাই বাতের ব্যথা। ট্রমা বা আঘাতজনিত ব্যথাকে বাদ দিলে বেশির ভাগ রোগজনিত ব্যথাই বাতের ব্যথা। সেগুলো রোগজনিত এবং বাতজনিত ব্যথাই। সব ধরনের ব্যথাই রিউম্যাটিক-সংক্রান্ত রোগ হিসেবেই ব্যাখ্যা করা যায়। যদি বলি, কোমরে ব্যথা হচ্ছে, এটাও একটি বাতজনিত ব্যথা। যখন আমরা বলব, বাতজনিত কোনো রোগের কারণে এই ব্যথা হচ্ছে, তখন পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
প্রশ্ন : একটু চিকিৎসার দিকে আসি। বাতের ব্যথায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যথানাশক ওষুধ খেতে দেওয়া হয়। কিডনি বিশেষজ্ঞরা আবার বলেন, ব্যথার ওষুধ বেশি দিন খাবেন না। এটা নিয়ে আতঙ্ক কাজ করে। এই সমন্বয় আপনারা কীভাবে করেন?
উত্তর : অনেকের ধারণা, বাত রোগ হয়ে গেছে। এটা আর সারবে না। এই ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। এখন চিকিৎসাবিজ্ঞান এতদূর এগিয়ে গেছে এবং গত ৩০-৩৫ বছর এ শাখায় এত অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে যে অনেক রোগই আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বেশ কিছু রোগে আমরা ‘আরোগ্য’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারছি না। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আমরা মনে করছি, আগামীতে অনেক রোগের নিরাময় হওয়ার ব্যবস্থা বেরিয়ে যাবে।
আমি বলব, একজন চিকিৎসক যখন চিকিৎসা করবেন, তখন তাঁর মাথার মধ্যে এটিও কাজ করবে যে ব্যথার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো। আমরা দেখি, রোগীরা অনেক সময় ব্যথা হলে ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে খেয়ে ফেলেন। এভাবে হয়তো দীর্ঘদিন ধরে চলছে। একসময় এটি কিডনিতে আক্রান্ত করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রকমটাই ঘটে। আমরা যখন চিকিৎসা করি, তখন মনিটর করি। দুই থেকে তিন মাস পরপর রক্ত পরীক্ষা করে দেখি যে কিডনির কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, লিভারের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এসব দেখেই আমরা চিকিৎসার চেষ্টা করি।
কিছু রোগ রয়েছে, এতে ব্যথার ওষুধ খেতে হবেই। এনকাইলজিং স্পনডিলাইটিস রোগের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ব্যথানাশক ওষুধ। এর চিকিৎসা ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে কখনোই ভালো করা যায় না। সে ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে রোগীর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়।