টাইফয়েড প্রতিরোধে কী করবেন?
টাইফয়েড পানিবাহিত একটি রোগ। এ সময়টায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। তবে একটু সচেতন হওয়া গেলে টাইফয়েড প্রতিরোধ করা সম্ভব। টাইফয়েড প্রতিরোধে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা জানানো হলো।
নিরাপদ খাবার খান
সাধারণত খাবার ও পানির মাধ্যমে টাইফয়েডের জীবাণু ছড়ালেও এ জীবাণু খুব সহজেই মেরে ফেলা সম্ভব হয়। খাবার ভালো করে জ্বাল দিলেই এ জীবাণু মেরে ফেলা সম্ভব। এ জন্য খাবার সঠিকভাবে রান্না করতে হবে। মাছ-মাংস ও শাকসবজি ভালো করে সিদ্ধ করে খেতে হবে। অনেকেই আছেন, যারা শাকসবজি-ফলমূল, মাছ-মাংস ট্যাপের পানিতে ধুয়ে কম সিদ্ধ করেন। এতে করে টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া খাবারে থেকে যেতে পারে। তাই শাকসবজি-ফলমূল পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। যেসব ফলমূলে খোসা নেই, সেগুলো খাওয়ার সময় খুব ভালো করে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুতে হবে। খোসাযুক্ত ফলমূল খাওয়ার আগে পরিষ্কার হাতে নিজেই খোসা ছাড়িয়ে নিন।
লেটুসের মতো সবজি খুব সহজেই দূষিত হয়ে যায় আর এগুলো ভালো করে পরিষ্কার করাও বেশ কষ্টকর। তাই এ ধরনের সবজি খাওয়ার আগে সাবধান। খুব ভালো করে ধুয়ে নিয়ে তবেই খেতে পারেন। রান্না ও খাবার সরবরাহ করার সময় হাত ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। শুধু তাই নয়, প্লেট, বাটি, চামচসহ বাসনকোসন, রান্না করার পাত্র ট্যাপের পানিতে না ধুয়ে ফোটানো বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে নিন।
তরিতরকারি কাটার জায়গাটিও সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। খাবার ঢেকে রাখুন। খাবারে মাছি বসলে সে খাবার খাবেন না। কারণ, শুধু টাইফয়েড নয় মাছির মাধ্যমে অনেক রোগের বিস্তার হয়ে থাকে।
পান করুন বিশুদ্ধ ও ফোটানো পানি
টাইফয়েড জীবাণু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। পানি পরিষ্কার দেখালেও সেখানে থাকতে পারে টাইফয়েডের জীবাণু। তাই খাবার পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ করে নিতে হবে। এ জন্য পানি ফুটিয়ে বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পানি ফুটতে থাকলে কমপক্ষে ১০ মিনিট ধরে জ্বাল দিন। আবার ফোটানো পানি যদি ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হয়, তাহলে বিশুদ্ধ পানি আবার জীবাণুর মাধ্যমে দূষিত হয়ে পড়তে পারে। তাই ফোটানো পানিকে একটি পরিষ্কার পাত্রে সব সময় ঢাকনা দিয়ে রেখে চার ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করুন। সংরক্ষণ করা পানি কোনো আলাদা পাত্র যেমন- মগ, বাটি, গ্লাস দিয়ে না তুলে পাত্রে ঢেলে পান করুন। বাইরের পানি পানের প্রয়োজন পড়লে বোতলজাত পানি পান করুন। এক টাকা গ্লাসের ফিল্টার পানি পান না করাই ভালো। কারণ এগুলো কতটা বিশুদ্ধ তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বোতলজাত পানির মধ্যে কার্বনেটযুক্ত পানি কার্বনেটবিহীন পানির চেয়ে অনেক নিরাপদ। বাইরে যাওয়ার আগে বাসা থেকে ফোটানো পানি বোতলে ভরে নিন। এতে করে খরচও বাঁচবে, সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবেন। পান করুন পাস্তুরিত দুধ।
হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন ও পরিচ্ছন্ন থাকুন
আপনি কতটুকু স্বাস্থ্যসচেতন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তা বোঝা যায় আপনার পরিবারে কেউ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছে কি না? টাইফয়েড থেকে বাঁচার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন সব সময়। শুধু হাত ধোয়ার অভ্যাসই পারে আপনাকে অনেকাংশে টাইফয়েডমুক্ত রাখতে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের বেশি বেশি হাত ধোয়ার অভ্যাস আছে, তাদের মধ্যে টাইফয়েড হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। তাই অবশ্যই খাওয়ার আগে ও পরে, প্রসাব-পায়খানার পর, খাবার রান্নার আগে, শিশুকে খাওয়ানোর আগে অবশ্যই ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। হাতে শুধু সাবান-পানি লাগালেই হবে না, হাতের সামনের ও পেছনের অংশ, দুই আঙুলের ফাঁকা জায়গা ও নখ ভালো করে প্রচুর পানি দিয়ে ধুতে হবে। অনেকেই নখ বড় রাখেন। নখ পরিষ্কার দেখালেও এখানে শুধু টাইফয়েডই নয়, আরো অনেক রোগের জীবাণু থাকতে পারে। এটি হতে পারে অনেক রোগের কারণ। তাই নখ ছোট রাখুন।
টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার করুন। যেখানে সেখানে প্রসাব-পায়খানা করবেন না। অনেকেই শিশুর পায়খানাকে খারাপ মনে না করে যেখানে সেখানে ফেলে দেন। শিশুর পায়খানাও ছড়াতে পারে টাইফয়েডের জীবাণু। তাই শিশুর পায়খানা টয়লেটে ফেলে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন।
বাইরের খাবার একেবারেই খাবেন না
বাইরের রেস্টুরেন্টের খাবারের প্রতি বা রাস্তাঘাটের খাবারের প্রতি লোভ অনেকেরই। এটা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক খারাপ হতে পারে। হতে পারে টাইফয়েডসহ জটিল জটিল রোগের কারণ। বাইরের খাবার যতই পরিচ্ছন্ন দেখাক না কেন, এগুলোতে সহজেই জীবাণুরা বাসা বাঁধতে পারে। আবার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বা ঠিকমতো ধুয়ে রান্না করা হয়েছে কি না তা আপনি জানেন না। রেস্টুরেন্টের সালাদ খাওয়া একেবারেই বাদ দিন। এটি খুব সহজেই পারে আপনার শরীরে জীবাণু ঢুকিয়ে দিতে। বাস্তার পাশে আখের রস, ফলমূলের রস, ঘোল বা মাঠাসহ নানা পানীয় বিক্রি করে। এগুলো সবই ট্যাপের পানিতে বানানো। আবার মাছিও এসবের ওপর বসে। তা ছাড়া যারা এগুলো বানায়, তারা মানে না ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি। তাই টাকা দিয়ে জীবাণু কিনে খাবেন না। রাস্তার পাশে বিক্রি করা আগে থেকেই কেটে রাখা আনারস, তরমুজসহ নানা ফলমূল জীবাণু ছড়াতে পারে খুব সহজেই। গরমে হকারদের ২-১০ টাকার আইসক্রিম বিক্রি করতে দেখা যায়। আর অনেকেই এগুলো দেদার কিনে খাচ্ছেন। এসব আইসক্রিম কিন্তু বানানো হয় ট্যাপের না ফোটানো পানি দিয়ে। তাই এগুলো একদমই খাবেন না।
ভ্যাকসিন নিন
টাইফয়েডের জন্য ভ্যাকসিন আছে। চার থেকে ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিতে হয়। এ ভ্যাকসিন দিতে হবে শরীরে জীবাণু প্রবেশের আগেই। দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিলে আপনি সাধারণত তিন বছরের জন্য টাইফয়েড থেকে রক্ষা পেতে পারেন। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর দিতে হবে বুস্টার ডোজ। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইফয়েড প্রতিরোধে এ ভ্যাকসিন ৫০-৮০ ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারে। এ জন্য শুধু ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করলেই হবে না। এ জন্য ভ্যাকসিনের পাশাপাশি নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আবার ছয় বছরের নিচের বাচ্চাদের ও গর্ভবতী মহিলাদের ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না।
আর এসব মেনে চলার পরও যদি টাইফয়েড হয়ে যায়, তাহলে দুচিন্তা করবেন না। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অনেক ভালো ভালো অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। নিয়মিত ও সঠিক সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
একটা কথা মনে রাখবেন, অ্যান্টিবায়োটিক কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করবেন না। আর অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স ঠিক সময়ে সম্পন্ন করবেন।