চিকুনগুনিয়া
জ্বর আসার আগেই গাঁটে ব্যথা হয়

গত এক থেকে দুই বছর ধরে খুব আলোচিত রোগের নাম চিকুনগুনিয়া। সম্প্রতি বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া নিয়ে এক হাজার ৩২৬ জন লোকের ওপর একটি গবেষণা করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জ্বরের আগে গাঁটে ব্যথা, জ্বর আক্রান্ত হওয়ার পর বিষণ্ণতা, দীর্ঘমেয়াদি শরীর ব্যথার সমস্যা হয়।
গবেষণাটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজনে কথা বলেছেন ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন। বর্তমানে তিনি বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কার্যনির্বাহী পরিচালক ও গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক।
প্রশ্ন : চিকুনগুনিয়া বিষয়ে গবেষণার জন্য আপনি উদ্বুদ্ধ হলেন কীভাবে?
উত্তর : আসলে মজার বিষয় হলো আমি যখন মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র ছিলাম, তখন চিকুনগুনিয়ার নাম শুনেছিলাম। কিন্তু চিকুনগুনিয়ার বিষয়ে তেমন ধারণা ছিল না। ২০১৭ সালে ঢাকায় যখন চিকুনগুনিয়া শুরু হলো, আমাদের বাসার সবাই চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্ত হয়। এই জন্য চিকিৎসক না হলেও চিকুনগুনিয়া নিয়ে আমার একটি ধারণা রয়েছে। চিকুনগুনিয়ার কিছু অন্যতম লক্ষণ রয়েছে।
চিকুনগুনিয়া হলে উচ্চ মাত্রার জ্বর হয়। যত জয়েন্ট রয়েছে শরীরে সেখানে ব্যথা হয়। অনেকের ক্ষেত্রে র্যাশ হয়; চুলকানি হয়। যদি ব্যথার পরিমাণ মাপা হয়, এক থেকে ১০, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ব্যথার মাত্রা সর্বোচ্চ।
অনেক মাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, প্রসব ব্যথা, আর চিকুনগুনিয়ার ব্যথা- দুটোর মধ্যে কোনটি বেশি কষ্টদায়ক। অনেকে বলেছে চিকুনগুনিয়ার ব্যথা বেশি।
এরপর এটি নিয়ে ফেসবুকে লেখা শুরু করলাম। রোগটির প্রকোপ এত বেশি ছিল যে এক পর্যায়ে মনে হলো, গবেষণা করি। আমার মনে হলো, আমার যেই কষ্টটা এটি যদি ডুকুমেন্টেশন হয়, তাহলে আগামীতে এর চিকিৎসায় অনেক কাজে লাগবে; চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধেও কাজে লাগবে।
প্রশ্ন : আপনাদের যে গবেষণা এর মূল পয়েন্ট কী ছিল? কোন কোন বিষয়কে আপনারা গুরুত্ব দিয়েছেন?
উত্তর : আমরা দেখেছিলাম, ক্লিনিক্যাল প্রোফাইলিং, হেলথ ইকোনমি ও কোয়ালিটি অব লাইফ। এই তিনটি প্যারামিটারকে আমরা নির্বাচন করেছিলাম। একটি ফেইস হলো একিউট (স্বল্পমেয়াদি) ফেইস। এটি সাধারণত দুই সপ্তাহ ধরে থাকে। আরেকটি হলো ক্রনিক (দীর্ঘমেয়াদি) ফেইস। এটি চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত থাকে। যেমন : আমার দুই বছর হয়ে গেল, এখনও প্রচণ্ড ব্যথা রয়েছে। যখন ব্যথা হয়, খুব ক্লান্ত লাগে। একটু হতাশাও কাজ করে।
প্রশ্ন : আপনাদের ফলাফলে কী আসল, কী পেলেন? এই গবেষণা চিকুনগুনিয়ার ব্যবস্থাপনায় কীভাবে ভূমিকা রাখবে?
উত্তর : বাংলাদেশে এই প্রথম চিকুনগুনিয়া বিশাল আকারে হয়েছে। এর আগে দুটো হয়েছিল। ঢাকার দোহারে, আর টাঙ্গাইলের পালপাড়ায়। ছোট মাত্রায় হয়েছিল। এর কারণে চিকুনগুনিয়া হলে কী হবে, কী করতে হবে, এ বিষয়ে চিকিৎসকদেরও ধারণা কম। ডেঙ্গু যখন প্রথম এভাবে হলো, তখন কেউ জানত না। তখন ডেঙ্গু নিয়ে অনেক রোগী মারা গেছে। তবে এখন হলেই ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়।
আমরা বিশ্বের অনেক বড় একটি গবেষণা করেছি। ১৩২৬ জন রোগীর ডাটা আমরা নিয়েছি। বিজ্ঞানসম্মতভাবে, নিয়ম মেনে যেভাবে কাজ করা দরকার, আমরা সেটি করেছি। আমরা তুলনা করেছি বাংলাদেশের চিকুনগুনিয়াতে কী কী ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় ঘটেছে। আমরা একটি নতুন বিষয় পেয়েছি, যেটি দিয়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াকে সহজে পার্থক্য করা যেতে পারে। সেটি হলো, অন্যান্য জ্বরে সাধারণত হঠাৎ করে জ্বর হয়। এরপর ব্যথা শুরু হয়। কিন্তু চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম সবার আগে গাঁটে ব্যথা হয়।
আমার যখন চিকুনগুনিয়া শুরু হয়, আমি তখন তারাবি নামাজ পড়ছিলাম। সেজদা দিতে পারছিলাম না। তখন আমি ভাবছিলাম যে মাসেল পুল করেছে হয়তো। জ্বর আসার তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে খুব ব্যথা শুরু হয়। আমরা যখন গবেষণাটির নকশা করলাম, তখন সেটির ওপর আমরা আলোকপাত করলাম। ৭৫ ভাগের ক্ষেত্রে একই লক্ষণ পেয়েছি। জ্বর আসার আগেই জয়েন্টে ব্যথা করেছে। এরপর জ্বর এসেছে। এই গবেষণাটি পলস নেগলেকটেড টপিক্যাল ডিজিজ জার্নালে এসেছে। এ ছাড়া আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, কিছু লক্ষণ রয়েছে অপ্রচলিত। যেমন : রক্তচাপ কমে যায়। আমরা অনেকগুলো কেস পেয়েছি এ রকম। আমি নিজেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা দেখেছি এখানে অনেক স্মৃতি শক্তি হারায়। যেমন, আমি অনেক কিছু মনে রাখতে পারি না। অনেকের হেলুসিনেশন হয়। আরেকটি বড় বিষয় হলো বুকে ব্যথা। অনেক রোগীর বুকে ব্যথা হয়েছিল। আমি তো ভেবেছিলাম কী হলো হঠাৎ। অনেক পরীক্ষা করে দেখলাম সব ঠিক রয়েছে।
এই পরামর্শগুলো চিকিৎসকরা জানলে রোগীকে আগে থেকেই বলতে পারবে। বিষণ্ণভাব হবে। অনেকের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। এই লক্ষণগুলো যদি চিকিৎসকরা বলেন, তাহলে রোগীদের ব্যবস্থাপনা করা সহজ হবে।
প্রশ্ন : চিকুনগুনিয়া সেরে যাওয়ার পরও ব্যথা অনেক দিন থেকে যেতে পারে। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? এ বিষয়ে আপনারা ফলাফলে কী পেয়েছেন?
উত্তর : চিকুনগুনিয়া ভালো হওয়ার পর এক বছর গবেষণা করেছি প্রায় ২৫০ রোগীর ওপর। এরা ক্লিনিক্যালই পজিটিভ ছিল। তাদের আমরা প্রতি মাসে ফলোআপ করেছি।
প্রশ্ন : চিকুনগুনিয়া পরবর্তী যে ব্যথা, এখানে ব্যায়ামের কোনো ভূমিকা রয়েছে কি?
উত্তর : চিকুনগুনিয়া পরবর্তী ব্যথা নিরাময়ে ব্যায়ামের ভূমিকা রয়েছে। চিকুনগুনিয়া হলে সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পর রোগী জমে যায়। ওই সময় ব্যথাটা খুব বেশি হয়। ওই সময় হাঁটাহাঁটি করতে হয়। একসঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কম্পিউটারের কাজ করা হলে, ব্যথা করতে থাকে। মাঝে মাঝে হাঁটাহাঁটি করলে ব্যথা কমে যায়।
প্রশ্ন : চিকুনগুনিয়া পরবর্তী ব্যথা দূর করতে আপনি নিজে কি ব্যায়াম করেন বা চিকিৎসকের কোনো পরামর্শ নিয়েছেন?
উত্তর : আমি সরাসরি চিকিৎসকের পরামর্শ নিইনি। তবে আমার অনেক চিকিৎসক বন্ধু রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, আমি নিজেও বিষয়গুলো জানতে গিয়ে দেখেছি ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : চিকুনগুনিয়া হলে রুচি কমে যাওয়া বা ওজন কমে যাওয়ার কোনো সমস্যা হয় কি? এমন কোনো বিষয় কি আপনারা গবেষণায় পেয়েছেন?
উত্তর : এটি আমাদের গবেষণার বিষয় ছিল না। তবে প্রথম দুই সপ্তাহ সংক্রমণ হওয়ার পর খাবার রুচি থাকে না। খাওয়ার মতো রুচিও কাজ করে না, মনও থাকে না।