আক্কেল দাঁত নিয়ে কী করবেন?
আক্কেল দাঁতের সমস্যা একটি প্রচলিত বিষয়। সময়মতো এই দাঁতের চিকিৎসা না নিলে এই সমস্যা জটিল হয়ে মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে। আজ ২৫ অক্টোবর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৮৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহমুদা আক্তার।
প্রশ্ন : আক্কেল দাঁত একটু বেশি বয়সে ওঠে, আমরা জানি। এবং এর সঙ্গে বুদ্ধির পরিপক্বতার একটি সম্পর্কের কথা বলা হয়। একে আমরা মেডিকেলের ভাষায় উইজডম টিথ বা থার্ড মোলার বলি। এই দাঁত অনেকেরই সমস্যা তৈরি করে বলে আমরা শুনতে পাই। কী ধরনের সমস্যা হয়?
উত্তর : আক্কেল দাঁত ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমত প্রচণ্ড ব্যথা হয়। মাড়িটা ফুলে যায়। এই ফোলাটা এত মারাত্মক হয় যে শুধু মুখের ভেতরে ফোলাটা থাকে না, গালের দিকে ফুলে ওঠে, গলার দিকে ফুলে ওঠে। রোগী হয়তো অনেক সময় দ্বিধায় পড়ে যায়। ভাবে, টনসিলের ব্যথা বা মামস হয়েছে। কারণ, আক্কেল দাঁতের জন্য যে গলা, মুখ ফুলে যেতে পারে, এ বিষয়ে আমাদের ধারণা কম। তাই রোগী দ্বিধায় পড়ে যায়। তবে আক্কেল দাঁতের জন্য এই সমস্যাগুলো প্রায়ই হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : অন্যান্য দাঁতের বেলায় তো এ ধরনের সমস্যা হয় না। তাহলে আক্কেল দাঁতের বেলায় এমন হয় কেন?
উত্তর : দুধের দাঁত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিচ থেকে আরেকটি দাঁত আসতে থাকে। ফলে ওইটির একটি জায়গা থাকে। তবে আক্কেল দাঁতগুলো ১৮ বছরের পরে ওঠে। তখন আমাদের মাড়ির টিস্যু একটু পুরু ও শক্ত হয়ে যায়। দাঁতটি আসতে হলে তো মাড়িকে একটু চিরে উঠতে হবে। ফলে ওঠার সময় চাপ হয় এবং মাড়িকে একটু কেটে কেটে সে বের হয়। সে জন্য এই ব্যথা থাকে।urgentPhoto
আবার অনেক সময় আক্কেল দাঁত একটু বাঁকা হয়ে ওঠে, অন্যান্য দাঁত সাধারণত সোজা হয়ে ওঠে। কিংবা হয়তো আক্কেল দাঁত উঠতেই পারছে না, বাঁকা হয়ে আছে অথবা শুয়ে আছে অথবা পেছনের দিকে একটু কাত হয়ে আছে—এই সমস্যাগুলো হয়। তার ওঠার প্রবণতা আছে; তবে এ ধরনের অবস্থার জন্য, ব্যথা এবং ফোলার জন্য দাঁতটি উঠতে পারছে না। ফলে একবার হয়তো ব্যথা হচ্ছে, আবার হচ্ছে—রোগী সাধারণত এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসে।
প্রশ্ন : এই যে না উঠতে পারা, এর কারণ কী? এর কারণ কি এমন হতে পারে যেহেতু এটি ১৮ বছরের পরে উঠছে, ওইখানে পর্যাপ্ত জায়গা কী দাঁতটি পাচ্ছে না বা চোয়ালের পরিমাপ বা বৃদ্ধি—এগুলো কি কোনো ভূমিকা রাখে?
উত্তর : এটা তো অবশ্যই একটি ভূমিকা রাখে। ১৮ বছরের সময় মোটামুটি আমাদের চোয়ালটি একটি আকৃতি নিয়ে নেয়। অনেক সময় অন্যান্য দাঁত আঁকাবাঁকা থাকে, তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোয়ালটা বড় হতে থাকে, দাঁতগুলো জায়গা পেয়ে যায়। তবে আক্কেল দাঁতটি হচ্ছে সবচেয়ে শেষ দাঁত। চোয়ালটি একটি আকার ধারণ করে ফেলে, ফলে দাঁতটি পর্যাপ্ত জায়গা পায় না। আবার অনেক সময় দেখা যায়, আক্কেল দাঁত যেহেতু শেষ দাঁত, তাই এর অবস্থার পরিবর্তন থাকে। সে হয়তো সোজা না হয়ে, শুয়ে আছে। ফলে সে তো আর উঠতে পারছে না বা একটু কাত হয়ে সামনের দাঁতের সঙ্গে আটকে গেছে। সে কারণে জায়গা না পেয়ে তখন সমস্যা তৈরি হয়।
প্রশ্ন : একসময় দাঁতের কোনো সমস্যা হলেই মানুষ ফেলে দিত। তবে এখন দন্ত চিকিৎসকরা বলছেন, দাঁত ফেলে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। উচিত হলো চিকিৎসা করে রক্ষা করা। ফলে মানুষ এই দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তবে আক্কেল দাঁতের বেলায় কোনো সমস্যা হলে আপনারা ফেলে দিতে বলেন—এর কারণ কী?
উত্তর : আসলে আমাদের প্রধান যে খাবারের দাঁত, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মোলার টিথ বলি, আক্কেল দাঁত সেই মোলার তিনটি দাঁতের মধ্যে একটি। তবে এগুলো আসলে আমাদের খাবার চিবানোর কাজে লাগছে না। সামনের যে মোলার টিথগুলো আছে, সেগুলোই আমাদের খাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে শেষ যে দাঁত, আক্কেল দাঁত—সেটি খাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না।
এই দাঁত মাঝেমধ্যে যেহেতু সমস্যা তৈরি করে এবং রোগীর জন্য, আমাদের জন্য উপকারী কিছু নয়, কোনো কাজে আসছে না—এ জন্যই আমরা বলি এটি ফেলে দেওয়ার জন্য। অনেক ভেতরে হওয়ার কারণে এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে চিকিৎসা, সেটিও জটিল। এই দাঁত সহজে পরিষ্কার হয় না বলে বারবার সমস্যা হয়। তবে দাঁতটা আমরা রক্ষা করতে চাই না, তা নয়। অনেক সময় রোগীর যদি মুখের আকৃতি ভালো থাকে, রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতিতে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক রোগী আছে, বলে আমি ফেলব না, তখন রুট ক্যানেল বা আরো অনেক পদ্ধতি আছে—সেগুলো দিয়ে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে মূলত যেহেতু এটা আমাদের খাওয়ার কাজে কোনো সাহায্য করছে না, তাই একে ফেলে দিতে বলি।
প্রশ্ন : দাঁত তুলে ফেলার কথা শুনলে মানুষের মধ্যে অনেক ভয় কাজ করে। সে সঙ্গে যদি আক্কেল দাঁত ফেলে দিতে হয়, তাহলে ভয় আরো বেশি। এই ভয় দূর করার উপায় কী? আসলে কি এটি ভয়ের কোনো বিষয়? কিংবা এই সার্জারিটি সুন্দরমতো, ভালোভাবে করতে হলে কার কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : অবশ্যই একটি দাঁত ফেলতে বললে মানুষের ভয় লাগবে। আপনি যদি আমাকে দাঁত ফেলতে বলেন, আমিও ভয় পাব। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে আক্কেল দাঁত ফেলাতে খুব ভয়ের কিছু নেই। আমরা যদি রোগীকে ভালোভাবে একটু পর্যায়গুলো বুঝিয়ে বলতে পারি, পরামর্শ দিয়ে নিই, এটা আসলে তেমন ভয়ের কিছু নয়।
এ ধরনের সমস্যা হলে রোগীকে প্রথমে ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জনদের কাছে যেতে হবে। তাঁরা যেহেতু এই বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন, তাঁরা ভালো করেই জানেন কোথায় ইনসিশন দিতে হবে। কোথায় হাড় কাটতে হবে। কীভাবে দাঁতকে চাপ দিয়ে তুলতে হবে। ফলে এটি রোগীর জন্য খুব ক্ষতিকর নয়, এখানে ভয় পাওয়ার তেমন কিছু নেই।
প্রশ্ন : আক্কেল দাঁত তোলার সময় কি স্থানীয়ভাবে অবশ (লোকাল অ্যানেসথেশিয়া) করে তোলার বিষয়, নাকি এর জন্য অজ্ঞান করারও প্রয়োজন হতে পারে? বা কোন সময় কোনটি ভালো?
উত্তর : যদি অবস্থান ভালো থাকে, তবে স্থানীয়ভাবে অবশ করে করতে পারি। আমাদের মাড়ির নিচের দিকে একটি রক্তনালি আছে। অনেক সময় দাঁতটি রক্তনালির কাছাকাছি থাকে, সে ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা পুরোপুরি অজ্ঞান করি।
প্রশ্ন : আক্কেল দাঁতের সমস্যা হলে কেউ যদি সময়মতো চিকিৎসা না নেন, তবে এই সংক্রমণ কতখানি ক্ষতির কারণ হতে পারে?
উত্তর : আক্কেল দাঁতে বারবার ব্যথা হচ্ছে, কমে যাচ্ছে—এতে অনেকেই একে এড়িয়ে যান। ভাবেন, এটি কোনো বিষয় নয়। তবে দাঁতটি যেহেতু একটি হাড়ের মধ্যে রয়েছে, সেই সংক্রমণ বাড়তে বাড়তে হাড়টি ক্ষয় হয়ে গলার দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি অনেক সময় কেবল ওই জায়গা নয়, সামনে-পেছনে এমনভাবে হয়ে আসে, যাকে আমরা জীবনঝুঁকির কারণ হিসেবে বলি। পুরো গলা ফুলে শক্ত হয়ে যায়। এ ধরনের রোগী এতটাই অস্থিতিশীল হয় যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে সার্জারি করাতে হয়। তখন তার জীবন বাঁচানো একটু ঝুঁকির হয়ে যায়।
প্রশ্ন : এটি কি গলা থেকে বুক পর্যন্ত বা মস্তিষ্ক পর্যন্ত ছড়াতে পারে?
উত্তর : হ্যাঁ। এটি ছড়াতে থাকে। এই সংক্রমণ গলার দিক থেকে বুকের দিকে নামতে পারে। এমনকি গলা থেকে শুরু করে মুখের ভেতর থেকে ওপরের দিকে চলে যেতে পারে।
প্রশ্ন : একজন মানুষের আক্কেল দাঁতের সমস্যা হলে মৃত্যুর ঝুঁকিও হয়ে যায়, আপনি বলছিলেন। এর কারণ কী, কেন হয়?
উত্তর : আসলে সংক্রমণ হলে সেখানে কিছুটা ফ্লুইড জমে। গলার দিকের টিস্যুগুলো নরম হয়, সেই পথ দিয়ে ফ্লুইডটি গলা দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। ফলে সেই সংক্রমণও ছড়াতে থাকে। এর ফলে গলা ফুলে যাচ্ছে। তখন সেটি আমাদের শ্বাসনালিকে চেপে ধরে। সে জন্য এর সময়মতো চিকিৎসা অবশ্যই করতে হবে।