গর্ভপাত কেন হয়?
গর্ভপাত একজন মায়ের জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে খুব কষ্টের বিষয়। তাই গর্ভধারণের পর সতর্ক থাকা জরুরি। ৩ ডিসেম্বর এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২২২৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. উৎপলা মজুমদার।
urgentPhoto
প্রশ্ন : গর্ভপাত বিষয়টি কী এবং এর পেছনে কারণগুলো কী?
উত্তর : মাতৃত্ব একজন নারীর গৌরবের বিষয়। যখন একজন মায়ের গর্ভে সন্তান আসে, তখন তিনি ও তাঁর পুরো পরিবার স্বপ্নে বিভোর হন। যখন এই গর্ভপাত হয়ে যায়, তখন তাঁদের পরিবারে একেবারে স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়। গর্ভকালীন প্রথম ২২ বা ২৪ সপ্তাহের মধ্যে যদি ৫০০ গ্রাম থেকে কম ওজনের একটি বাচ্চা প্রসব হয় সেই ক্ষেত্রে বাচ্চাটি আর স্বতন্ত্রভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। এই বিষয়টিকে আমরা গর্ভপাত বলি।
প্রশ্ন : এই ঝুঁকির মধ্যে কারা পড়ছেন? গর্ভপাতের কারণ কী?
উত্তর : গর্ভপাতের বিষয়টি হচ্ছে, যে সংখ্যাটি দেখা যায়, ১০০টি গর্ভাবস্থা যদি হয়, তার মধ্যে ১০ থেকে ২০টি সন্তান গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ হয়ে যাচ্ছে। এর বিভিন্ন কারণ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ৭৫ শতাংশ গর্ভপাত হয়ে থাকে প্রথম তিন মাসের মধ্যে। এদের প্রায় ৫০ শতাংশ কারণই হয় ক্রমোজমাল অস্বাভাবিকতা যদি থাকে সেই কারণে। সেটা হয়তো স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণ থাকে না। ত্রুটিপূর্ণ কোনো গর্ভধারণ থাকে। প্রথম তিন মাসের মধ্যে বাচ্চাগুলো গর্ভপাত হয়ে যায়। এরপর প্রথম ট্রিমেস্টারে মিসক্যারেজের যে কারণগুলো আছে সেগুলো এ রকম- মায়ের যদি হরমোনাল কোনো ঘাটতি থাকে, প্রোজেস্টেরন বলি এর যদি আধিক্য থাকে। থাইরয়েড হরমোনের যদি আধিক্য বা ঘাটতি থাকে, সেই ক্ষেত্রেও গর্ভপাত হতে পারে। এ ছাড়া কিছু সংক্রমণ আছে, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা প্যারাসাইটিক ইনফেকশন- সেসব কারণেও হতে পারে। মায়ের যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, সেসব কারণেও প্রথম তিন মাসে গর্ভপাত হতে পারে। এরপরের তিন মাস থেকে ছয় মাসের মধ্যে যে গর্ভপাতগুলো হয়, তার মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে জরায়ু যদি খুব দুর্বল বা জরায়ুর মুখ যদি একটু বড় হয়ে যায়, সেসব ক্ষেত্রে গর্ভের যে সন্তানটি বেড়ে উঠছে; তাকে সে ধরে রাখতে পারে না। এই কারণেও গর্ভপাত হতে পারে। এ ছাড়া জরায়ুর ভেতরে পরিবেশ যদি ভালো না হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু বিনাইন টিউমার রয়েছে, ভালো কিছু টিউমার যেমন ফাইব্রয়েড, সেটা থাকলে বাচ্চা সেভাবে বড় হতে পারে না। সেই সব ক্ষেত্রেও গর্ভপাত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন কেমিক্যাল রয়েছে, আর্সেনিক দূষণ বা কেমোথেরাপি এসব বিভিন্ন কারণে গর্ভপাত হতে পারে।
প্রশ্ন : একজন মা যখন শিশু বহন করছেন এবং গর্ভপাতের মতো একটি কষ্টকর বিষয় তাঁকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এরপর যখন তিনি আবার মা হতে যাচ্ছেন আবারও কি তাঁর একই দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে?
উত্তর : আসলে গর্ভপাতের তো অনেক ভাগ রয়েছে। এটি অনেক সময় বারবার হতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রেই নয়। যদি কারো হরমোনের সমস্যা থাকে, তার ক্ষেত্রে হয়তো তার বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে বা জরায়ুর মুখ যদি ঢিলা থাকে, সেই ক্ষেত্রেও বারবার হতে পারে। তবে অবশ্যই এগুলো নিরাময়যোগ্য যদি তিনি চিকিৎসকের কাছে যান এবং চিকিৎসা করিয়ে নেন তাহলে তো বারবার, হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
প্রশ্ন : এই জাতীয় সমস্যা হলে আপনারা কীভাবে রোগীদের ব্যবস্থাপনা করে থাকেন?
উত্তর : যদি হরমোনের সমস্যা থাকে, আমরা হয়তো তাঁকে চিকিৎসা দিই বা জরায়ুর মুখ যদি ঢিলা থাকে সেই ক্ষেত্রে ১৪ সপ্তাহ বা ১২ সপ্তাহের দিকে জরায়ুর মুখকে শক্ত করার জন্য একটি সেলাই দিয়ে থাকি, সেই ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তান ভালো থাকে।
প্রশ্ন : একজন মায়ের যদি গর্ভপাতের ইতিহাস থাকে, সেই ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার যদি তিনি আবার মা হতে চান, তাঁদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন পরিচর্চা বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের প্রতি কতটুকু আপনারা জোর দেন? সেখানে কি বিশেষ কোনো যত্নের প্রয়োজন আছে কি না?
উত্তর : যার গর্ভপাতের ইতিহাস রয়েছে, সেই মা-তো অবশ্যই একটু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। তাঁকে বিশেষভাবে খেয়াল নিয়ে আমরা দেখি কী কারণে তার গর্ভের শিশুটি গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিল সেটি বের করার চেষ্টা করি। যদি বারবার হওয়ার মতো কোনো কারণ থাকে, সেগুলোর চিকিৎসা আমরা দিই। আর অনেক সময় থাকে যে ক্রোমোজোমাল অস্বাভাবিকতা বা আমাদের এই উপমহাদেশে এই বিষয়ে করার কিছু থাকে না, সেসব ক্ষেত্রে আমরা হয়তো তাঁকে বিশ্রাম দিই। কিছু ওষুধ রয়েছে রোগীর মনের অবস্থাকে কিছুটা ভালো রাখতে পারে। এইভাবে তাঁকে আমরা পরিচর্যা চালিয়ে যাই।
প্রশ্ন : মানসিকভাবে আশ্বস্ত করতে আপনারা তাদের কী ধরনের কথা বলে থাকেন?
উত্তর : যেকোনো রোগী চিকিৎসকের কাছে আসলে তার কথা শুনে অনেকটা ভালো হয়ে যায়। পরামর্শ অনেক বড় একটি বিষয় রোগীদের জন্য। যার ক্ষেত্রে কোনো কারণ ছাড়াই হয়েছে- তার ক্ষেত্রে হয়তো পরীক্ষা করে বলি, আপনার সব কিছু ভালো আছে। নিজের প্রতি একটু যত্ন, বিশ্রাম নেবেন, খেয়াল করবেন। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে রোগীরা এত আশ্বস্ত হয়।
প্রশ্ন : গর্ভপাতের ইতিহাস আছে যার, তিনি যখন আবার মা হবেন, তাঁর আবারও গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার কতখানি ঝুঁকি রয়েছে?
উত্তর : গর্ভপাতের কারণ না ঠিক করে যদি তিনি সন্তান নিচ্ছেন- এমন হলে এই সমস্যা হতে পারে। পরামর্শ হচ্ছে, আগে কারণ বের করতে হবে। এরপর সঠিক চিকিৎসা নিলে আর সমস্যার সম্ভাবনা থাকে না।
প্রশ্ন : গর্ভপাত প্রতিরোধে কোনো বিষয় রয়েছে কি না?
উত্তর : অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য কিছু বিষয় রয়েছে। প্রথম তিন মাস একটু তো ঝুঁকির মধ্যে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আমরা হয়তো একটু বিশ্রামে থাকতে বলি, দীর্ঘ ভ্রমণ করতে না করি। কিছু কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলো খেলে হয়তো বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেগুলো যেন তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া না খান, সে ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। আর কারো যদি কোনো সমস্যা পেয়ে যাই সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসা যদি আমরা দিয়ে দিতে পারি, হয়তো বা গর্ভস্থ শিশুটির আর গর্ভপাত হবে না।
প্রশ্ন : অনেকে ধারণা করেন, প্রথম বাচ্চা যদি এমআর করার ইতিহাস থাকে, তবে পরের বাচ্চাটির গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এটি আসলে কতখানি সত্য?
উত্তর : এটি আসলে কোথায় এমআরটি হচ্ছে, সেটির ওপর নির্ভর করে। তবে এখন অনেক ওষুধ এসেছে- নয় সপ্তাহের মধ্যে এমআর ছাড়াই মেডিসিন দিয়ে গর্ভপাত করানো সম্ভব। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে আসলে খুব একটি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যদি দক্ষ হাতে বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন উপায়ে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে আমরা এমআরটি করাই, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন : শেষ পর্যায়ে একটু জানতে চাই, একজন মা যাতে পুরো গর্ভাবস্থা সুস্থভাবে অতিবাহিত করতে পারেন এবং একটি সুস্থ মা জন্ম দিতে পারেন- এ ক্ষেত্রে পরামর্শ কী থাকবে?
উত্তর : অবশ্যই প্রি-কনসেপশনাল চেকআপ মা করিয়ে নেবেন। একটি সন্তান নিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। তার যদি কোনো রোগ থাকে সেগুলো তিনি সারিয়ে নেবেন। কোনো ক্ষতিকর ওষুধ যদি খেয়ে থাকেন যেগুলো বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর হবে, সেগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অবশ্যই তিনি বদলে নেবেন। এটি হলো গর্ভধারণের আগে চেকআপ। এরপর গর্ভধারণের পর। এ সময় প্রতি মাসে চিকিৎসকের কাছে যাবেন। চিকিৎসকের নিয়মিত চেকআপে থাকবেন। বিশ্রাম নেবেন।
প্রশ্ন : কী লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে গর্ভপাত হচ্ছে?
উত্তর : এই ক্ষেত্রে রোগী যে সমস্যা নিয়ে আসেন, তিনি হয়তো অল্প সময়ের জন্য গর্ভবতী, হঠাৎ করে তাঁর রক্তস্রাব হচ্ছে, এটা প্রথম একটি সমস্যা যেটা মা আমাদের কাছে নিয়ে আসে। আবার অনেক সময় আছে এই যে রক্তস্রাব হচ্ছে সেটি ফোঁটায় ফোঁটায় হচ্ছে অথবা অনেক বেশি পরিমাণ হচ্ছে। কালচে রঙের অথবা একেবারে তাজা লাল রক্ত। সঙ্গেথে কখনো পেটে ব্যথা হচ্ছে। অনেক সময় খুব বেশি রক্তপাত হয়। কখনো কখনো রোগী আমাদের বলেন, মাংসের মতো কোনো চাকা বের হয়েছে। আর অনেক সময় যদি অদক্ষ হাতে গর্ভপাত করা হয়, রোগী আমাদের কাছে আসেন জ্বর নিয়ে, সাথে দুর্গন্ধ যুক্ত সাদাস্রাব। এই ধরনের লক্ষণ গুলো আমরা সচরাচর রোগীদের ভেতর পাই।
প্রশ্ন : আরেকটি বিষয় রয়েছে সেপটিক গর্ভপাত, এটি কাদের ক্ষেত্রে হয়?
উত্তর : যেকোনো গর্ভপাতে বৈধ বা অবৈধ, মা যদি টারমিনেট করতে চান, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে। দক্ষ হাতে করলে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় করলে, কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এগুলো অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। আমাদের দেশে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত হচ্ছে সেপটিক গর্ভপাত। এ সময় রোগীকে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় পাই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে যন্ত্র দিয়ে করা হয়েছে সেটি ভালো ছিল না- খাদ্যনাণি হয়তো ফুটো হয়ে গেছে। রোগীকে অনেক সময় আমরা বাঁচাতে পারি না।