বিশ্ব ক্যানসার দিবস
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন ক্যানসার?
আজ ৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ক্যানসার দিবস। ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয় রয়েছে অনেক। আজ এনটিভির ২২৮৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন। বর্তমানে তিনি নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ক্যানসার সেন্টারের ক্যানসার বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি সারা পৃথিবীব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এ বছরে এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য কী? এবং বাংলাদেশে এ উপলক্ষে কী ধরনের আয়োজন চলছে?
উত্তর : আমরা জানি, সারা বিশ্বে ক্যানসারের প্রকোপ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এর প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে গেছে। আমাদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অ্যাগেইনস্ট ক্যানসার। তারাই প্রতিবছর এই দিবস উদযাপনের জন্য পৃথিবীব্যাপী কিছু কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে থাকে। এই বছর তাদের যে প্রতিপাদ্য, সেটি আমরাও বাংলাদেশে ব্যবহার করছি। সেটি হলো: ‘উই ক্যান, আই ক্যান’। অর্থাৎ কিছু কিছু কাজ সবাই মিলে করতে পারি, কিছু কিছু কাজ একাও করতে পারি। এতে সম্মিলিতভাবে ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রশ্ন : উই ক্যান মানে আমরা পারি। মানে সম্মিলিতভাবে সবার তরফ থেকে কিছু একটা করণীয় রয়েছে। আর আই কেন মানে প্রত্যেকে আমরা যে যার জায়গা থেকে কিছু ভূমিকা পালন করতে পারি। যদি একটু বুঝিয়ে বলেন ক্যানসার প্রতিরোধে আমরা কী কী করতে পারি?
উত্তর : আমি প্রথমে আই ক্যান (আমি পারি) বলতে চাই। তাতে উই ক্যান ( আমরা পারি) বোঝানো সহজ হবে। আমরা বলি, ক্যানসার একটি জীবনযাত্রা সম্পর্কিত রোগ। আমরা বলি, মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, চলাফেরা, জীবনের আচরণ, খাদ্যাভ্যাস- এগুলোর সাথে ক্যানসারের একটি সম্পর্ক আছে। আমরা অনেকেই ব্যায়ামই করি না। আমাদের শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে না। ব্যায়াম ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমি এটা নিজে করতে পারি। আমি খাবারের মধ্যে প্রচুর চর্বি খাই, এটি চাইলে নাও খেতে পারি। আমি প্রচুর শাকসবজি ফলমূল খেতে পারি। যাতে ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহজ হয়। এটা আমি করতে পারি। আমি কিন্তু প্রতি মাসে নিজেই স্তন পরীক্ষা করে দেখতে পারি এবং মাঝেমধ্যে কোনো সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে চলে যেতে পারি।
কিছু বদ অভ্যাস রয়েছে যেগুলো আমি পরিহার করতে পারি। যেমন : ধূমপান করা, তামাকজাত দ্রব্য সেবন করা, অনেকে আবার অ্যালকোহল পান করেন- এগুলোর সবকটিই কিন্তু ক্যানসারের সাথে জড়িত। এই অভ্যাস থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি, যদি আমরা নিজেরাই চাই। তাহলে আমরা ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব।
ক্যানসার তৈরি করার জন্য যেসব জিনিস ঝুঁকি বাড়ায় তার অনেকগুলোই আমাদের হাতেই থাকে। প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে চাইলে নিজেকে সেসব কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। এর মানে ‘আমি পারি’।
প্রশ্ন : আর ‘আমরা কী পারি’?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে অনেক কাজ আছে। বেশির ভাগ ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। যদি আমরা প্রাথমিকভাবে ক্যানসার নির্ণয় করতে চাই, তাহলে এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার যেন দেশের সব জায়গাতে ক্যানসার রোগটি সহজে নির্ণয় করা যায়। এতে কিছু কিছু জিনিস তৈরি করা দরকার, সমন্বয় দরকার। আর একজন ব্যক্তি একা তো সব কাজ করতে পারে না। সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে আমরা একে প্রতিরোধ করতে পারি। এটা নানাভাবে আমরা করতে পারি। ক্যানসার চিকিৎসার জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার দরকার হয়। শল্য চিকিৎসা লাগে, ক্যামোথেরাপি দরকার, রেডিয়েশন থেরাপি দরকার। এগুলো একজন ব্যক্তি একা করতে পারে না। এর মানে এটি একটি দলগত কাজ। একক চিকিৎসক ক্যানসার চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নন। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা লাগে। এমনকি প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও সম্মলিত কিছু ভূমিকা রয়েছে। যেমন : আমরা যদি ধূমপান বন্ধ করতে চাই বা তামাকের ব্যবহার বন্ধ করতে চাই, তাহলে কিন্তু আমাদের এর উপরে ট্যাক্স বাড়ানো দরকার। যাতে করে মানুষ কম খায়। প্রতিরোধের জন্য সরকারের সহযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা কিন্তু খুবই জরুরি। নয়তো প্রতিরোধ করা খুব কঠিন।
এরপর আমাদের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য অনেক লোকবল দরকার। এই জিনিসগুলো কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে করা সম্ভব নয়। সামাজিক বা রাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া এ কাজগুলো করা সম্ভব নয়। যদি নিজে পারি এবং সবাই মিলে পারি- তাহলে অনেক বেশি কিছু অর্জন করতে পারব। আমি এবং আমরা এই দুটোর যখন যোগফল হবে তখন অর্জন অনেক বেশি হবে; ভালো হবে।
প্রশ্ন : সব ক্যানসারই সমানভাবে প্রতিরোধ যোগ্য নয়। যে ক্যানসারগুলো আমরা চাইলে প্রতিরোধ করতে পারি সেগুলো কী?
উত্তর : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছেলেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেই ক্যানসার, সেটি হলো ফুসফুসের ক্যানসার। এটি একটি অত্যন্ত মারাত্মক ক্যানসার। এটি হয়ে গেলে মানুষের আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। ধূমপান না করলে এই ক্যানসার অনেক কমে যায়। এ ছাড়া হেডনেক ক্যানসারগুলোও কিন্তু ধূমপানের সাথে অনেক জড়িত। এগুলো চিবিয়ে খাওয়া তামাকের সাথে জড়িত। জর্দা, খৈনি এগুলোর সাথে জড়িত। এগুলো ব্যবহার না করলে সম্পূর্ণভাবে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। এতে কোনো রকম সন্দেহ নেই। সুতরাং এগুলো কিন্তু বেশ সহজ কাজ। মেয়েদের ক্যানসারের মধ্যে আমরা বেশি দেখি স্তন ক্যানসার। স্তন ক্যানসার আসলে প্রতিরোধ করা কঠিন। তবে আমরা খুব দ্রুত এটিকে নির্ণয় করে ফেলতে পারি। প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করতে পারলে কিন্তু একশ ভাগ রোগীই ভালো থাকবে এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।
আর মেয়েদের আরেকটি ক্যানসার রয়েছে, জরায়ুমুখের ক্যানসার। ওটাও যদি আমরা তাড়াতাড়ি ধরতে পারি তাহলে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
এ ছাড়া আমরা যদি কোলন ক্যানসারে কোলোনস্কোপি করি, আমরা সহজেই কিন্তু নির্ণয় করতে পারি। আর পাকস্থলীর ক্যানসারগুলো আমরা এন্ডোস্কোপি করলে সহজে বুঝতে পারি।
আরেকটি ক্যানসার এখন আমাদের দেশে বাড়ছে সেটি হলো লিভারের ক্যানসার। হেপাটাইটিস বি আমাদের দেশে অনেক বেড়ে গেছে। এর জন্য যদি কেউ ভ্যাকসিন দেয়, তাহলে কিন্তু আগে থেকে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। আবার জরায়ুমুখের ক্যানসারের জন্য বাংলাদেশে কিন্তু ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। এটি ব্যবহার করলে মেয়েদেরও আর জরায়ুমুখের ক্যানসার হচ্ছে না। এই সুযোগগুলো কিন্তু আমাদের সামনে আছে। আমরা চাইলে সেটি করতে পারি।
প্রশ্ন : কোন ক্যানসারগুলো আগেভাগে নির্ণয় করা সম্ভব? এবং সেটি কীভাবে?
উত্তর : স্তনের ক্যানসারটা আগেভাগে নির্ণয় করতে পারি। জরায়ুমুখের ক্যানসারটা নির্ণয় করতে পারি। হেডনেক ক্যানসারগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই আগেভাগে নির্ণয় করা সম্ভব, যদি নিয়মিত স্ক্রিনিং করি। যেমন : জিহ্বার ক্যানসার, মুখ গহ্বরের ক্যানসার। একটি খবর দিতে চাই, আমাদের দেশের ক্যানসার চিকিৎসার প্রচুর উন্নতি ঘটছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কাজ করা হচ্ছে।