ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির ভূমিকা
ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির অনেক ভূমিকা রয়েছে। আজ ২ ফেব্রুয়ারি, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৮৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. রশিদ উন নবী। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : ক্যানসার অত্যন্ত মারাত্মক একটি রোগ। সবাই ক্যানসারের নাম শুনলেই আতঙ্কবোধ করেন। কারণ, ক্যানসার রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে ক্যানসারের চিকিৎসাও ঝুঁকিপূর্ণ। এর চিকিৎসা নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা রকমের ভীতি রয়েছে। একটু বলেন, মানুষের শরীরের ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির ভূমিকা কতখানি?
উত্তর : ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির ভূমিকার অবদান অনস্বীকার্য। অনেক ক্যানসার আমরা প্রথম অবস্থায় অস্ত্রোপচার বা সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করি। তার পরও কিন্তু রেডিওথেরাপির প্রয়োজন পড়েই। আবার অনেক জায়গায় প্রথম অবস্থায় রেডিওথেরাপির দরকার নেই। যেমন ধরেন, কোলন ক্যানসার। শুধু সার্জারি বা কেমোথেরাপিই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। দেখা গেল, হয়তো তিন বছর পর সেই কোষ হাড়ে বাসা বেঁধে হাড়কে ভেঙে দিচ্ছে। অথবা মস্তিষ্কে চলে যাচ্ছে। ওই মুহূর্তে কিন্তু সবচেয়ে জরুরি চিকিৎসা হলো রেডিওথেরাপি। তাই যেখানে লাগে না, সেখানেও পরে রেডিওথেরাপি লাগতে পারে।urgentPhoto
আর কিছু কিছু জায়গা তো রেডিওথেরাপি ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা এতটা ফলপ্রসূ হয় না। তার মধ্যে হেডনেক ক্যানসার অন্যতম। এখানে রেডিওথেরাপির ভূমিকা অসাধারণ। এ ছাড়া জরায়ুমুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপির ভূমিকা অসাধারণ। এ রকমভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় ফুসফুসের ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, মস্তিষ্কের টিউমার এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে রেডিওথেরাপির ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে।
প্রশ্ন : রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কি এখন পরাজিত করতে পেরেছে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা?
উত্তর : আসলে এই ভীতি নিয়ে মানুষকে দোষ দেওয়া যাবে না। আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগে, এই যন্ত্রপাতিগুলো দেওয়া হতো সেগুলো রেডিয়েশনের ডোজ ত্বকের ওপরেই ছিল শতভাগ।
যেহেতু ত্বকের ওপর শতভাগ ছিল, দেখা গেল যে একটি নির্দিষ্ট থেরাপি দেওয়ার পর সম্পূর্ণ ত্বকটা পুড়ে যেত। একটা সময় আমাদের বিভাগকে বলা হতো শ্যাঁকের বিভাগ। আমার দাদিও মারা গেছে ক্যানসারে। রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে উনি মারা গেছেন। ক্যানসার রোগ ভালো হয়ে গেছে। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি আর সারানো যায়নি।
তবে এখন রেডিওথেরাপির জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির ডোজ শতভাগ ত্বকের ওপরে নেই, ত্বকের ভেতরে। এতে ত্বক আর সে রকমভাবে পুড়ে যাচ্ছে না। এ জন্য রেডিওথেরাপি এখন মানুষের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে। এখন বিশাল জনগোষ্ঠী এই চিকিৎসার আওতায় চলে আসছে।
তবে মানুষের শরীরের বিশেষ বিশেষ কিছু জায়গা আছে, যেগুলো রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে সংবেদনশীল। ওখানে ডোজ অনেক কম রাখতে হয়। ওই ডোজ কম রাখতে না পারলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হয়। ধরেন, যেখানে মস্তিষ্কের চিকিৎসা করছেন, মস্তিষ্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে। এখন ওখানে যদি রেডিয়েশনের ডোজ কম দিতে না পারেন, তাতে কিন্তু রোগীর অনেক ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। সুতরাং রেডিয়েশনটা সতর্কভাবে ব্যবহার করতে হবে।
আর যেহেতু কেমোথেরাপি আমাদের সারা শরীরে কাজ করে, তাই এর বিষাক্ততা অনেক বেশি হয়। যেমন—কেমোথেরাপির প্রয়োগটা স্তন ক্যানসারে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রেডিওথেরাপির তুলনায়। তবে ৮০ ভাগ আবার রেডিওথেরাপিও লাগে।
স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দিতে এত কষ্ট হয় যে তারা জিজ্ঞেস করে রেডিওথেরাপি দিতেও কি কষ্ট হবে? তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, ওই রোগীই যখন রেডিওথেরাপি দেয়, তখন বলে স্যার এটি তো কেমোথেরাপির মতো নয়। একেকটি চিকিৎসার একেক ধরনের স্টাইল বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
প্রশ্ন : হেডনেক অঞ্চলে রেডিওথেরাপি দেওয়ার ফলে রোগীরা যে প্রচলিত অভিযোগগুলো করেন যে তার মুখ শুকিয়ে আসছে, মুখে ঘা হচ্ছে, মুখের হাঁ ছোট হয়ে যাচ্ছে, এগুলো কতটা বেশি হয়। এটি কি স্থায়ী?
উত্তর : প্রথমত, আমাদের দাঁতের মাড়ি, জিহ্বা বা দাঁতে যদি ক্যানসার বাসা বাঁধে, আমরা যখন সার্জারি করলাম, তখন রেডিওথেরাপি লাগল, তবে আমাদের জিহ্বা দিয়ে গাল দিয়ে যাচ্ছে, তখন টিস্যুগুলো একটু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেটাকে আমরা বলি ওরাল মিউকোসাইটিস। তাতে জিহ্বার ঘা দেখা যায়। এই বিষয় কিন্তু সাংঘাতিক। আমরা কিন্তু বিভিন্ন ধরনের রেডিয়েশন দিয়ে রাখি যেন তাদের কষ্ট কম হয়। আস্তে আস্তে যখন রেডিওথেরাপি শেষ হয়, তখন রোগী ভালো হতে থাকে। দুই-তিন মাসের মধ্যে আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে।
আর স্যালাইভা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়ার বিষয়টি হলো এখানে প্যারোটি গ্ল্যান্ড থাকে। রেডিয়েশন যখন প্যারোটিক গ্ল্যান্ড দিয়ে যায়, তখনই এই সমস্যাগুলো বেশি হয়। সুতরাং ওই সব ক্ষেত্রে আমাদের দেখতে হবে যে প্যারোটি গ্ল্যান্ড যেন বেশি ডোজ না পায়। প্যারোটি গ্ল্যান্ড দুটো থাকে। একটি প্যারোটি গ্ল্যান্ডে কাজ করলেও আরেকটি যেন ঠিক থাকে, সেটি দেখতে হবে।
তবে এখন অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি আসার কারণে আমরা এই অঙ্গগুলোকে অনেক নিরাপদ রাখতে পারি। আমাদের জটিলতা অনেক কমে গেছে।
প্রশ্ন : হেডনেক অঞ্চলে রেডিয়েশন দিতে গেলে তার মুখের প্রস্তুতির কোনো বিষয় রয়েছে কি?
উত্তর : বিশেষ করে যারা বয়স্ক রোগী, তাদের কারো যদি কোনো বাজে দাঁত থাকে, তখন দন্ত্য চিকিৎসকের কাছে পাঠাই যেন বাজে দাঁতগুলো তুলে ফেলা হয়। তুলে ফেললে তার দাঁতের ব্যথা বা যন্ত্রণা অনেক কমে যায়। আর এর পর আমরা মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সব সময় মেনে চলতে বলি। এ বিষয়ে রেডিওথেরাপি দেওয়ার আগে সতর্ক হতে হবে।