শিশুর জন্মগত ত্রুটি কেন হয়?
আজ ১৬ মার্চ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৭৬তম পর্বে শিশুর জন্মগত ত্রুটি নিয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাত্রী ও প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম।
প্রশ্ন : অনেক শিশুই শারীরিক এবং মানসিক ত্রুটি নিয়ে জন্মায়, প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মায়, এটি কেন হয়?
উত্তর : জন্মগত ত্রুটি বিভিন্নভাবে হতে পারে। একটি ত্রুটি গঠনগত কারণে হয়; এটি দেখা যায়। এ সমস্যায় হয়তো শিশুর হাত বা পা থাকে না। আরেকটিকে বলা হয় ফাংশনাল ত্রুটি, এ ক্ষেত্রে হয়তো শিশুর বুদ্ধি ঠিকমতো হয় না; সে কানে শুনতে পায় না বা চোখে দেখতে পারে না। অপরটি হলো মেটাবলিক ত্রুটি, সেটা স্বাভাবিকভাবে বোঝা যায় না; কিছু আচরণ দিয়ে বোঝা যায়। যেমন : কনজেনটাল হাইপোথারোয়েডিজম। সারা পৃথিবীতেই চার হাজারেরও বেশি শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। আমাদের দেশেও এই সমস্যা রয়েছে।
প্রশ্ন : এর কারণ কী?
উত্তর : কারণ অনেক। এরমধ্যে একটি হলো জেনেটিক কারণ। এটা হঠাৎ করে হতে পারে। আবার অনেক সময় যদি নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হয় এদের সমস্যা হতে পারে। অথবা বেশি বয়সে সন্তান নিলেও অনেক সময় ডিমের মধ্যে বা স্পার্মের মধ্যে ত্রুটি হতে পারে।
প্রশ্ন : বয়সের কারণে যে সমস্যাটি হয় সেটা কি নারী-পুরুষ উভয়ের বেলায় প্রযোজ্য?
উত্তর : নারীর বেলায় সমস্যা হতে পারে ৩৫ বছরের পরে এবং পুরুষের বেলায় হতে পারে ৫০ বছরের পরে। ছেলেরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। কারণ ছেলেদের স্পার্মের সমস্যায় জন্য এই ত্রুটি হয়।
প্রশ্ন : ত্রুটিপূর্ণ সন্তান হওয়ার পেছনে পরিবেশগত কী কারণ জড়িত?
উত্তর : কাজের পরিবেশ অনেক জড়িত। যারা ব্যাটারি ফেক্টরিতে কাজ করে তাদের এই সমস্যা হতে পারে। নারীর মধ্যে যারা পার্লারে কাজ করে তারা ব্লিচ করার জন্য যেসব জিনিস ব্যবহার করে এর ফলে সমস্যা হতে পারে। আমরা যে পানি পান করি, এর মধ্যে অনেক সময় প্রেসটিসাইজড, হারবিসাইজড থাকে, সেগুলো সমস্যা তৈরি করে। এ ছাড়া খাবারের মধ্যে প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে এসবের কারণেও সমস্যা হয়।
একটা শিশু জন্মের প্রথম তিন মাসের মধ্যে তার সব অঙ্গপ্রতঙ্গ তৈরি হয়ে যায়। তখন যা কিছু খাওয়া হয় সবই মায়ের কাছ থেকে বাচ্চার শরীরে যেতে পারে। এর প্রভাবেই শিশু সুস্থ হবে না অসুস্থ হবে- তা অনেকটাই বোঝা যায়।
অনেক সময় দেখা যায় মা হয়তো ধূমপান করে না, বাবা করে, এক্ষেত্রে মা পরোক্ষ ধূমপায়ী হয়ে যায়।
প্রশ্ন : অনেকেই নানা রকম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে সেই বিষয়গুলোও কী সন্তানের ক্ষতি করে?
উত্তর : শিশুর জন্মগত ত্রুটি হওয়ার পেছনে নেশা একটি বিষয়। নেশা অনেক ক্ষতি করে। এর প্রভাব হয়তো আমরা এখন বুঝব না। আরো ১০ বছর পরে বুঝতে পারব যে আমাদের সমাজের কতখানি ক্ষতি এই নেশার জন্য হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : ঝুঁকিপূর্ণ মাকে তাঁর জীবনযাপন, খাবারদাবারের বিষয়ে কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : যদি কোনো মা ত্রুটি পূর্ণ শিশু জন্ম দেয় তবে অবশ্যই তাঁর বাচ্চা নেওয়ার আগে পরামর্শ ( কাউন্সেলিং) দরকার। অনেক সময় জেনেটিক টেস্ট করা হয়, স্বামী-স্ত্রীর ক্রমোজোমাল টেস্টও করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি যখন গর্ভধারণ করেন আমরা তখন প্রতিরোধ হিসেবে ফলিক এসিড, মাল্টিভিটামিন দিই, বি ভিটামিন দেওয়া হয়। হাইডোজ এ ভিটামিন না দেওয়াই ভালো। ফলিক এসিড-৪ মিলিগ্রাম গর্ভধারণের এক মাস আগে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হয়। তারপর গর্ভধারণ করলে অনেক সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়।
এ ছাড়া মাকে আমরা কিছু টেস্ট করিয়ে থাকি। যেমন : গর্ভধারণের প্রথম ১৩ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর সমস্যা আছে কি না দেখা হয়। তার পরবর্তী সময়ে ২২ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে এনোমালি স্কেন করি। এখন কিন্তু সব অঙ্গপ্রতঙ্গই আল্ট্রাসোনোগ্রামের মধ্য দিয়ে দেখা যায়। তবে বেশি আল্ট্রাসোনোগ্রাম করাও কিন্তু শিশুর জন্য ক্ষতিকর। আল্ট্রাসাউন্ড বিম শিশুর বৃদ্ধিকে ক্ষতি করে।
প্রশ্ন : ত্রুটিপূর্ণ শিশু জন্মদানের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাকেই দায়ী করা হয়। যেসব কুসংস্কার প্রচলিত আছে সে বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : কুসংস্কার তো কুসংস্কারই। এর কোনো ভিত্তি নেই। স্বামীর বয়স যদি বেশি হয় সেক্ষেত্রে সিমেন এনালাইসিস করা হয় , স্পার্মের অবস্থা কীরকম সেটা দেখা হয়। তার মোরফোলজি কীরকম, গঠনগত কোনো ত্রুটি রয়েছে কি না এসবও দেখা হয়। এমনকি স্বামী যদি স্বাস্থ্যবান হন সে ক্ষেত্রেও কিন্তু শিশুর সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্বামী এবং স্ত্রীকে আমরা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে বলি এবং খাবারদাবার পরিবর্তনে কিছু পরামর্শ দেই। যেমন, বলা হয় গরুর মাংস এড়িয়ে গেলে ভালো। ফার্মের মুরগি এড়িয়ে যেতে বলি। ফল, সবজি এসব খেতে বলা হয়।
প্রশ্ন : আমরা জানি, ত্রুটিপূর্ণ বাচ্চা হওয়ার পেছনে কিছু ভাইরাসও দায়ী। সে ক্ষেত্রে টিকা বা ভ্যাকসিনের কী ভূমিকা আছে? একজন সন্তানসম্ভবা মা না বুঝে অনেক ওষুধ খেয়ে ফেলতে পারে, এতে কী ধরনের সমস্যা হয়?
উত্তর : রুবেলা ভাইরাসের কারণে সমস্যা হয়। পরিকল্পিত গর্ভধারণের এক মাস আগে থেকে প্রয়োজন হলে রুবেলা ভেকসিন দিতে হবে। এর ফলে রুবেলা সম্পর্কিত সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়। এ ছাড়া আরো অনেক ভাইরাস যেমন : সাইটোমেগালা, টক্সোপ্লাজমা, প্লাবোভাইরাস এমনকি ফ্লু ভাইরাস, চিকেন পক্স ভাইরাস এসব থেকেও সমস্যা হয়। সে জন্য বলব, গর্ভধারণের সময় নারীটিকে কোনো অবস্থাতেই বেশি ভিড়ের মধ্যে যাওয়া ঠিক না। কোনো সংক্রমিত রোগী থাকলে তার থেকে একটু দূরে থাকতে হবে। খাবার দাবারে সাবধান হতে হবে। কোনো ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা যাবে না। আর গর্ভধারণের আগে যদি কোনো ওষুধ খায় তবে গর্ভধারণের সময় কী সেই ধরনের ওষুধ খাবে কি না সেটা চিকিৎসকের কাছে জেনে নিতে হবে।
প্রশ্ন : অনেকের ধারণা থাকে গর্ভকালীন আয়রন, ফলিক এসিড, ভিটামিন এসব ওষুধ খাওয়া ভালো। সেটি কি নিজে নিজে খাওয়া তার ক্ষতির কারণ হতে পারে?
উত্তর : কখনোই নিজে নিজে কোনো চিকিৎসাপত্র বানানো উচিত নয়। ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে। কেননা প্রত্যেকটি ওষুধেরই একটি মাত্রা আছে। মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ তার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।