আঁকাবাঁকা শিরার চিকিৎসা কী?
অনেকেরই আঁকাবাঁকা শিরার সমস্যা থাকে। এই বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩২১তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. এস এম জি সাকলায়েন। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় ভাসকুলার বিশেষজ্ঞ সার্জন হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : আঁকাবাঁকা শিরা কী, শুরুতে এই বিষয়টি জানতে চাই।
উত্তর : এককথায় বলতে গেলে এটি একটি রোগ। যেটি পায়ের রক্তনালি, যেটি আমরা ওপরের দিকের রক্তনালি বা শিরা বলি, এগুলো আক্রান্ত হয় অনেকের ক্ষেত্রে। তখন সেই রক্তনালিগুলো আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। আঁকাবাঁকা শিরা পায়ে হয়, হাতে হয় শরীরের সব জায়গায় হতে পারে। তখন একে ভেরিকোস ভেন বলি। আসলে ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্স নামক একটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের শব্দ রয়েছে, সেটিরই রূপান্তর হচ্ছে ভেরিকোস ভেন। তবে অনেকে জানে না এটি আদৌ কোনো রোগ কি না। এবং রোগ হয়ে গেলে কার কাছে যেতে হবে এটি জানে না। এক কথায় বলতে গেলে এটি আসলে রক্তনালির রোগ।
প্রশ্ন : তাহলে এই সমস্যায় কার কাছে যেতে হবে?
উত্তর : শেষের কথাটা শুরুতেই বলে দিচ্ছি। আসলে ভেরিকোস ভেন মানে শিরা, শিরা মানেই তো রক্তনালি। এটি ভাসকুলার সম্পর্কিত সমস্যা। এর মানে একজন ভাসকুলার সার্জনের কাছে যাওয়া জরুরি। আমাদের দেশে বেশ কিছু সংখ্যক ভাসকুলার সার্জন এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছেন, যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
প্রশ্ন : আঁকাবাঁকা শিরার পেছনের কারণগুলো কী?
উত্তর : আমাদের শরীরে আসলে শিরা থাকে। শিরাগুলো দুই সারিতে অবস্থান করে। একটি হচ্ছে গভীরের দিকে, একটি হচ্ছে ওপরের দিকে। শিরাগুলোর মধ্যে ভাল্ভ থাকে। যেগুলো রক্তকে একমুখে যেতে সহায়তা করে। এই ভাল্ভগুলোর কোনোটিতে যদি সমস্যা হয়, অথবা শিরার গায়ের মধ্যে যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, সেগুলো রক্তকে একমুখে যেতে সহায়তা করে। এই ভাল্ভগুলোতে যদি কোনো সমস্যা হয়, অথবা শিরার গায়ের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা হয় অথবা শিরার গায়ের মধ্যে যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, সেটি জন্মগত হতে পারে। অথবা অন্য কোনো কারণ পরবর্তী সময় পড়তে পারে। দুর্বল হয়ে গেলে তখন গভীর শিরার যে চাপটা, সেটি ওপরের শিরার মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। ওপরের শিরাগুলো আসলে পাতলা থাকে, চিকন থাকে ওই চাপটা নিতে পারে না। নিতে না পারার জন্য এঁকেবেঁকে যায়। তখন একে আমরা আঁকাবাঁকা শিরা বা ভেরিকোস ভেন বলি।
প্রশ্ন : কী দেখে বোঝা যাবে তার আঁকাবাঁকা শিরার সমস্যা হচ্ছে?
উত্তর : একটি সময়ে আসলে একে বলা হতো ট্রাফিক পুলিশের রোগ। অনেক বইয়ে এখনো একে বলা হয় ট্রাফিক পুলিশ রোগ। মূলত যেটা হয় ট্রাফিক পুলিশরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এখন শুধু ট্রাফিক নয়, অনেক মানুষকেই কোনো কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে হয়। দাঁড়িয়ে থাকার কারণে পায়ের চাপটা যখন বেড়ে যায়, তখনই রক্তনালিগুলো আঁকাবাঁকা দেখা যায়। এ ছাড়া অনেকের পায়ের গভীর শিরায় ব্লক হতে পারে। গর্ভাবস্থায় অনেকের পায়ের রক্তনালিগুলো আঁকাবাঁকা হয়ে যেতে পারে। রক্তনালিকে সাধারণ মানুষ সাধারণত রগ বলে। রগগুলোকে আঁকাবাঁকা দেখা যাচ্ছে এই একটি। আরেকটি হলো সে হাঁটতে গেলে মনে হবে পা একটু ভারী ভারী লাগছে। অনেকের ক্ষেত্রে জটিলতার দিকে গেলে পায়ের গোড়ালি কালো হয়ে যায়। এমনকি অনেকে ত্বকের চিকিৎসকের কাছে যায়। বছরের পর বছর এখানে-ওখানে চিকিৎসার জন্য ছুটোছুটি করে। মনে করে তার পা কালো হয়ে গেছে তাই ত্বকের সমস্যা। একসময় সেখান থেকে রক্তপাত হতে পারে। পায়ের গোড়ালির দিকে ঘা হতে পারে। এ রকম অবস্থা নিয়ে প্রচুর সংখ্যক লোক আসে। অনেকে জানেই না এটি তার কোনো রোগ।
আমাদের কাছে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকেও প্রচুরসংখ্যক লোক আসেন বা প্রবাসীরা আসেন। এর কারণ মূলত তাঁরা সেখানে অনেক ওজন নেওয়ার কাজ করেন এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। দেশে থাকলে রোগটিকে গুরুত্ব না দিলেও বা রোগ না হলেও ওখানে গিয়ে রোগ প্রকাশিত হয়। তখন কিন্তু তাদের অযোগ্য বলা হয়। বলা হয়, সুস্থ হয়ে আসো। তখন তারা আমাদের কাছে আসেন। মোটামুটি শতভাগ সুস্থ হয়ে তাঁদের কাজে ফিরে যেতে পারেন।
প্রশ্ন : এই জাতীয় সমস্যা নিয়ে এলে প্রাথমিকভাবে আপনাদের করণীয় কী থাকে?
উত্তর : আমাদের কাছে আসলে দেখেই বুঝতে পারি তার কী সমস্যা রয়েছে। পাশাপাশি আমরা ডপলার বা ডুপ্লেক্স পরীক্ষা করি। এটি করে আমরা দেখি তার গভীর শিরাটা ঠিক আছে কি না। কারণ একটি আঁকাবাঁকা শিরাকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা থাকে। এ ক্ষেত্রে গভীর শিরাটা ঠিক থাকা জরুরি। প্রথমে এটা হওয়ার কারণ খুঁজে বের করি। তখন বুঝি অস্ত্রোপচার করা যাবে কি না। আমরা কয়েকটি উপদেশ তখন তাঁকে দিই। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তখন আমরা বলি বিছানার পায়ের দিকটা একটু উঁচু রাখবেন। উঁচু মানে এমন নয় বালিশে রাখবেন। বিছানার ওই জায়গাটা একটু উঁচু রাখতে হবে। বালিশে রাখলে পায়ে হাঁটুতে ব্যথা হয়ে যাবে। এতে এক রোগ থেকে আরেক রোগের সমস্যা হবে। তখন এক রোগের জায়গায় আরেক রোগ শুরু হয়ে যায়।
আরেকটি হলো মেডিকেটেড একধরনের মোজা রয়েছে, এটি ঊরু পর্যন্ত পরার সুযোগ থাকে। ওই মোজা পরে হাঁটাচলা করলে আর এই সমস্যাটা হবে না। এই দুটো কথা বলি। আর বলি আপনি দীর্ঘক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকবেন না। এই নিয়মগুলো মানার পরও যদি দেখা যায়, তার এই রোগটি আরো বাড়ছে, তখন ঘা শুকানোর ব্যবস্থা করতে হয়। পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : কোন রোগীর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করতেই হয়?
উত্তর : যেই বিষয়গুলো বললাম, সেই উপদেশগুলো মানার পরও যদি তার সমস্যা চলতে থাকে অথবা সে মনে করছে আমার এটা দেখতে সুন্দর লাগে না, অথবা সে মনে করছে সে কর্মক্ষেত্রে যাবে, সেনাবাহিনীতে যাবে, দেশের বাইরে চাকরি করবে তখন করতে হয়। এ রকম সমস্যা থাকলে সে যেতেই পারবে না। সেনাবাহিনীতে তাকে নেবে না।
অস্ত্রোপচার করার ক্ষেত্রে কনভেনশনাল পদ্ধতি তো আছেই। পাশাপাশি সম্প্রতি বাংলাদেশে লেজার পদ্ধতি বের হয়েছে।
প্রশ্ন : আমি যতটুকু জানি এই ক্ষেত্রে আপনিই বাংলাদেশে লেজার নিয়ে এসেছেন। কী রকম সাড়া পাচ্ছেন এ ক্ষেত্রে?
উত্তর : সারা পৃথিবীতেই আসলে এখন লেজার চলছে। পাশাপাশি আরএফ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এবলেশন চালু হচ্ছে।
আমরা যখন শুনলাম দেশের বাইরে তারা লেজার দিয়ে এই শিরাকে ঠিক করছে, আমাদের দেশে তখনো এটি চালু হয়নি। আমাদের দেশে তখন লেজার মেশিনের দাম তিন কোটি টাকা ছিল। তখন একজন লেজার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি। উনি ভাসকুলার সার্জন নয়, তবে লেজার বিশেষজ্ঞ। তখন আরেকজন ভাসকুলার সার্জন জি এম মকবুল হোসেন সায় দেন। এরপর আমরা প্রায় শ-খানেক রোগী লেজার দিয়ে চিকিৎসা করেছি। ফলাফল খুবই ভালো।
প্রশ্ন : কনভেনশনাল অস্ত্রোপচার সিস্টেম আর লেজারের মধ্যে পার্থক্য কী? কোনটার প্রতি বেশি ঝুঁকছে বলে মনে করেন?
উত্তর : দেখুন, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের একটি প্রবণতা হলো অস্ত্রোপচার থেকে বাঁচা। লেজারের ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো কাটাছেঁড়া নেই। কোনো ধরনের সেলাই বা সুতোর ব্যবহার নেই। কাটাছেঁড়া ছাড়াই তাকে সুস্থ করে দিতে পারছি।
কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অবশ্য লেজার করা যায় না। তবে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই করা যায়। লেজারের সুবিধা হলো কাটাছেঁড়া লাগছে না। দুই পা একসঙ্গে করতে পারছে। আরেকটি সুবিধা হলো খরচ প্রায় কাছাকাছি। খুবই সামান্য পার্থক্য থাকে। হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় না। পরের দিন বাড়িতে চলে যেতে পারে। অস্ত্রোপচার মানে তো পায়ে দাগ, মনেও দাগ। তবে লেজারের ক্ষেত্রে কোথাও আর দাগ থাকছে না।