শিশুর ক্যানসারে সতর্ক হোন

কেবল বড়দেরই নয়, শিশুদেরও ক্যানসার হয়। তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে ক্যানসার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. তাসনীম আরা। তিনি আমেরিকার চিলড্রেন হসপিটাল লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যানসার, বোন ম্যারো ইমিউনো থেরাপি ও স্টেম সেল থেরাপির ওপর গবেষণা শেষে বর্তমানে দেশে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন।
urgentPhoto
এনটিভির প্রতিদিনকার আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৩৩৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা হয় ডা. তাসনীমের সঙ্গে।
প্রশ্ন : শিশুদের ক্যানসার সারা পৃথিবীতেই রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে ইদানীং খুব শোনা যায়। শিশুদের নানা ধরনের ক্যানসার হয়। শিশুদের ক্যানসারগুলোর মধ্যে কোনগুলো রয়েছে, সেগুলোর সার্জিক্যাল চিকিৎসা রয়েছে?
উত্তর : শিশু ক্যানসারের মধ্যে মূলত দুটো ভাগ। হেমোটোলজি অনকোলজির মধ্যে লিউকোমিয়া, লিম্ফোমিয়া। বাকি সব সলিড টিউমার শিশুদের মধ্যে। আমরা বলি, সব শিশুদেরই ক্যানসারের সময় একটি লাম্প হবে, শরীরের যেকোনো জায়গায়। এটি কিডনিতে হতে পারে। লিভারে হতে পারে। পেটের যেকোনো জায়গায় হতে পারে। সবগুলো চিকিৎসারই প্রথমে প্রাথমিকভাবে সার্জারি দরকার। সার্জারির পরে পরবর্তী সময়ে কেমো বা রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে সার্জারিই করতে হয়। সার্জারি করেই পরবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসা কী হবে—সেটি নির্ধারণ করতে হয়।
প্রশ্ন : শিশুদের যে ক্যানসার তার মধ্যে কিছু রয়েছে খুব খারাপ ধরনের ক্যানসার, কিছু আছে অত খারাপ নয়। সময়মতো চিকিৎসা করলে নিরাময় সম্ভব। ওই ক্যানসারগুলোর ধরন ভেদে যদি একটু বলেন?
উত্তর : আমাদের দেশে শিশুদের ক্ষেত্রে নেফ্রোব্লাসটোমার সংখ্যা বেশি। কিডনিতে হয় টিউমারটি। যুক্তরাষ্ট্রে সার্জারির পর যেই মাধ্যম দিয়ে চিকিৎসা করা হয়, সেখানে শতকরা ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়টি ভালো হয়ে যায়। পরে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর কোনো সমস্যা থাকে না। আমাদের দেশে কিডনি টিউমার, নিউরোব্লাসটোমা—এ রকম অনেকগুলো টিউমার রয়েছে, যাদের প্রাথমিক পর্যায়ে যদি চিকিৎসা করা হয়, তবে শতকরা ৭০ থেকে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ভালো করে দেওয়ার সম্ভব। সম্পূর্ণ নিরাময় না হলেও ফলোআপে থেকে পূর্ণ বয়স্ক অবস্থাতেও সুস্থ থাকতে পারবে।
প্রশ্ন : কিছুর সারকোমাও হয়। অত্যন্ত জটিল ক্যানসার। চিকিৎসার বিষয়ে এর সফলতার হার কেমন?
উত্তর : সারকোমা একটু জটিল। রেবডোমায়ো সারকোমা, মাংসপেশিতে হয়। এটার চিকিৎসা উন্নত বিশ্বেও একটু জটিল। এখানে সার্জারি একটি ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এর পরে এর জটিলতা অনেক বেশি। সে জন্য সারকোমা জাতীয় জিনিসগুলোর চিকিৎসা একটু জটিল। সার্জারির পরও দেখা যায় জটিলতা বাড়তে থাকে।
কিন্তু আরেক ধরনের টিউমার আছে, যেমন অস্টিওসারকোমা- এগুলো যদি হয়, তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে সার্জারি করে একে ভালো করা যায়।
প্রশ্ন : ক্যানসারের বেলায় সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও, ধারণা করা হয় এর জন্য কিছু ঝুঁকির কারণ রয়েছে। যেমন ফুসফুস ক্যানসারের বেলায় ধূমপান। মুখের বা গলার ক্যানসারের বেলায় ধোঁয়াহীন তামাক—এ রকম নানা বিষয় রয়েছে। তবে একটি শিশু যে এসব কোনো কিছুতে আসে না, তার বেলায়ও ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে এটি কেন?
উত্তর : ক্যানসারের মূল কারণ হলো ডিএনএ-তে পরিবর্তন। ডিএনএ-তে পরিবর্তন হয় একদম কোষের ভেতরে, যখন পরিবর্তন হয়। একজন গর্ভবতী মা কিন্তু নানা ধরনের পরিবেশের মধ্যে আছেন। উনি রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসতে পারেন, ধোঁয়ার মধ্যে যেতে পারেন। উনি রক্তশূন্যতায় ভুগতে পারেন, অপুষ্টিতে ভুগতে পারেন, পরিবেশ দূষণে পড়তে পারেন। বিভিন্ন কারণগুলো মায়ের ওপর পড়তে পারে। এগুলো খুব বড় কারণ।
মা যখন গর্ভবতী থাকেন তখনই এই কারণগুলো গর্ভস্থ শিশুর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। তখন জন্মের পরপরই দেখা যায় যে শিশুর টিউমারটি মা যখন গর্ভবতী তখনই শুরু হয়েছিল। যেমন সব ধরনের ব্লাসটোমা টিউমারগুলো জন্মের আগের থেকে কিডনির ভেতর থেকে তৈরি হতে থাকে। আস্তে আস্তে বাচ্চা যখন এক থেকে পাঁচ বছর বয়সে বড় হয়ে থাকে, তখন আমরা রোগ নির্ণয় করতে পারি। তবে এটি শুরু হয়েছে মায়ের পেট থেকে।
প্রশ্ন : শিশুর ক্যানসার হয়েছে এটি বোঝার উপায় কী? মায়ের কী কর্তব্য এখানে?
উত্তর : শিশুদের ক্যানসারটি খুবই নীরব থাকে। কারণ এটি আস্তেধীরে বড় হয়। বাচ্চাদের ক্যানসারের বিষয়টি বুঝতে হলে মায়েদের একটু সচেতন হতে হবে। শিশুদেরও যে ক্যানসার হতে পারে, এই বিষয়ে মায়েরা যেন সচেতন থাকেন।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হবে, বিশ্বের সব জায়গাতেই এটি বলে দেওয়া হয়, বাচ্চাকে যখন গোসল করাবে, কাপড় পরাবে, হাতেপায়ে যখন তেল মালিশ করবে, লোশন দেওয়া হবে, তখন বাচ্চার পেটে-পিঠে চাপ দিয়ে দিয়ে দেখে, যেন অনুভব করে শিশু স্বাভাবিক আছে।
যখন দেখা যায় যে নেফ্রোব্লাসটোমা—যদি এটি আগেভাগে ধরা পড়ে, এর চিকিৎসা শুধু সার্জারি দিয়েই ঠিক করা যায়, এমনকি কেমোথেরাপি লাগবে না, ক্যাসোথেরাপির কোনো প্রশ্নই আসে না। শুধু সার্জারি দিয়ে ৯৭ শতাংশ ভালো হয়ে যাওয়া সম্ভব।
কিন্তু এই ক্যানসারগুলো তখনই ধরা পড়ে যখন মা গোসল করাতে গিয়ে চাপ দিয়ে দেখে বাচ্চার পেটে লাম্প দেখা যাচ্ছে। তখন যদি আসে, তাহলে পর্যায় এক বা পর্যায় দুই-এর সময়ই আমরা সার্জারি করে শিশুকে ভালো করতে পারি। যেমন একটি টিউমার আছে ন্যাজোব্লাস্টিক ন্যাফ্রোব্লাসটার। এটি এক বছরের নিচের শিশুদের হয়। মা যখন বাচ্চাকে গোসল করাবে তখনই যেন মা টের পায়। শিশু তো এখানে বলতেই পারবে না। মাকেই জানতে হবে। কোনো রকম অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে যেন চিকিৎসকের কাছে যান।
প্রশ্ন : কিছু ক্যানসার আছে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা করা হলে নিরাময় সম্ভব। আবার কিছু ক্যানসার আছে, এর ধরনটাই এত খারাপ যে যত ভালো চিকিৎসাই করা হোক, এরপরও আমরা অসহায় বোধ করি। শিশুদের ক্যানসারের বেলায় কোন ক্যানসারগুলো চিকিৎসা করলে ভালো হওয়া সম্ভাবনা বেশি? আর কোনগুলো একটু দুরারোগ্য?
উত্তর : যেমন আমি প্রথমেই বললাম কিডনির টিউমার—শতকরা ৯৭ ভাগই চিকিৎসা সম্ভব। নিউরোব্লাসটোমা, অন্য যেকোনো সলিড টিউমার, ট্যারাটোমা, ওভারিয়ান ট্যারাটোমা—মেয়ে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। সার্জারি করার সঙ্গে সঙ্গেই সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব।
আর আপনি যেটা আগেই বলেছিলেন—সারকোমা, এগুলো খুব জটিল। এই সারকোমার সার্জারির সময় দেখতে হবে কোন জায়গা থেকে এই টিউমারটি উঠেছে। জায়গা অনুযায়ী চিকিৎসাটা নির্ভর করবে। কিন্তু এরপরও আমরা এমনভাবে বলতে পারব না যে কোনো ক্যানসারের চিকিৎসা নেই। চিকিৎসা আছে। যত তাড়াতাড়ি করা যাবে তত ভালো। এখানে সঠিক রোগ নির্ণয় করতে হবে। বর্তমানে সব ধরনের ক্যানসারের নতুন নতুন চিকিৎসা উদ্ভব হয়েছে। ভালো চিকিৎসা রয়েছে। টারগেটেট থেরাপি, সেল থেরাপি, কেমো, রেডিও তো ছিলই; সঙ্গে এই চিকিৎসাগুলোও চলে এসেছে।
এ ছাড়া এখন বায়োপসির পরপরই ইমিউনো ফেনোটাইপ এই পরীক্ষাগুলো করে, যদি রোগের সঠিক রোগনির্ণয় করতে পারি, তার জন্য সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থাও আছে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এই চিকিৎসার মান কেমন?
উত্তর : বাংলাদেশে চিকিৎসা নেওয়ার যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সবই বর্তমানে আছে। এখন রোগ নির্ণয়টাকে আরো একটু সঠিকভাবে করতে পারলে আরো ভালো হয়। রক্তের পরীক্ষা সব জায়গায় করা যায়, আলট্রাসনোগ্রাম করা যায়। আমরা আশাবাদী ধীরে ধীরে আমরা আরো ভালো করব।