শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ কী?

জন্মগত ত্রুটি একটি বড় ধরনের সমস্যা শিশুদের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন কারণে একটি শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৪৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।
প্রশ্ন : শিশুদের জন্মগত ত্রুটি বলতে আসলে কী বুঝি?
উত্তর : জন্মগত ত্রুটি মানে হলো, যে ত্রুটিটি আমরা জন্ম থেকে দেখি, সেটাই হলো জন্মগত ত্রুটি। কিছু কিছু জন্মগত ত্রুটি রয়েছে যেটি শিশু প্রসবের আগে অর্থাৎ সে যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখনো বের করা যায়। আর কিছু রয়েছে, যেটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। কখনো ছয় মাস বা এক বছর সময় লাগে সমস্যা বুঝতে। যেমন : একটি বাচ্চার যদি মাথার দিকে কোনো সমস্যা থাকে বা পেটের কোনো ত্রুটি থাকে বা কোনো একটি অঙ্গ ঠিকমতো নেই, এ ধরনের ত্রুটিগুলো আগে বোঝা যায়। আর যদি তার ফাংশনাল সমস্যা থাকে, যেমন সে হয়তো বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, সেটা কিন্তু আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারব না। বাচ্চা যখন আস্তে আস্তে বড় হবে, তখন বোঝা যাবে যে সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তার কার্যক্রমের মাধ্যমে সেটা বোঝা যাবে।
আবার কিছু কিছু জিনিস রয়েছে, যেমন থেলাসেমিয়া। এটিও কিন্তু একটি জন্মগত ত্রুটি। থেলাসেমিয়া আমাদের দেশে অনেক বেশি প্রচলিত। থেলাসেমিয়া রোগটিও একটি জন্মগত ত্রুটি। ছয় মাস আগে যদি শিশু থেলাসেমিক হয়, ছয় মাস পরে দেখা যাবে শিশু খুব এনিমিক হয়ে যাচ্ছে। কাজেই সব জন্মগত ত্রুটি আমরা প্রসবের আগে বুঝতে পারব না।
প্রশ্ন : প্রসবের আগেই যদি বোঝা যায় শিশুটি জন্মগত ত্রুটি নিয়ে হচ্ছে, তাহলে কী করণীয় রয়েছে?
উত্তর : আসলে জন্মগত ত্রুটি দুই ধরনের হয়। একটি হলো বড় ত্রুটি। আরেকটি হলো ছোট ত্রুটি। এখন ছোট ত্রুটি যদি হয়, যেমন : গঠনগত ত্রুটি, ঠোঁট কাটা বা তালু কাটা- সেটা নিয়ে সে কিন্তু তার জীবন চালাতে পারে। কিন্তু যদি তার বড় ধরনের সমস্যা হয়, যেমন স্পাইনো মাইলোমেলেঙ্গসিস, নিউরাল টিউব ডিফেক্ট ইত্যাদি, তখন সমস্যা হয়। অনেক সময় বাচ্চা প্যারালাইজড থাকবে সারা জীবন, সে হয়তো আর হাঁটতে পারবে না। সে কিন্তু বেঁচে থাকবে, তবে বাবা-মায়ের কাছে সারা জীবনের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে। এই জিনিসগুলো আমাদের নির্ণয় করা দরকার। সেই নির্ণয়ের জন্য জন্মগত ত্রুটিটি কী কারণে হচ্ছে সেটি আমাদের জানা দরকার। তাহলে আমরা বুঝতে পারব কীভাবে আমরা একে নির্ণয় করব।
প্রশ্ন : জন্মগত ত্রুটির কারণগুলো কী?
উত্তর : কারণগুলো হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে ক্রোমোজোমাল ডিফেক্ট বা জেনেটিক ডিফেক্ট। ক্রোমোজোমাল ডিফেক্ট কিন্তু পরিবার থেকে আসে। আজকাল আমরা প্রায়ই দেখি আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয়, সেটা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেশনে হোক বা সেকেন্ড ডিগ্রি রিলেশনে হোক এদের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।
আরেকটি হতে পারে। যেমন : মায়ের কিছু সংক্রমণ বাচ্চার ক্ষতি করে। এমনকি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণও বাচ্চার ক্ষতি করে। আমরা আজকাল দেখি অনেক বেশি চিকেন পক্স হচ্ছে। প্রথম তিন মাসের মধ্যে সমস্যা হলে বাচ্চার ত্রুটি হতে পারে। টর্স সংক্রমণ, পারভোভাইরাস সংক্রমণ- এ ধরনের অনেক সংক্রমণ আছে যেগুলো বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে। এটা হয়তো আমরা বুঝতেও পারি না। তবে এটি বাচ্চার ক্ষতি করে দিতে পারে।
তারপর স্বামী যদি ধূমপান করে, ধূমপানের যে ধোঁয়া বাচ্চার শরীরের ভেতরে যাচ্ছে, সেটি শিশু বয়সে লিউকোমিয়া করতে পারে। আজকাল কিন্তু অনেকেই মদ্যপান করে। মাদক নিচ্ছে। এটি বাচ্চার জন্য বিশাল ক্ষতির বিষয়। এগুলো বাচ্চার ত্রুটি তৈরি করতে পারে।
তারপর পরিবেশ একটি বিষয়। আমি কী খাচ্ছি? পরিবেশে বিষাক্ততা হয়তো এত বেশি যে জন্মগত ত্রুটি করে দিতে পারে। আসলে ত্রুটির সব বিষয়গুলো আমরা জানতেও পারব না। যেমন : ফাংশনাল ত্রুটি। আমি যদি বলি অটিজম, আমি জানতে পারব না। কিন্তু ডাউন সিনড্রম নির্ণয় করা সম্ভব।
এটি নির্ণয় করার জন্য একটি দম্পতি চিকিৎসার জন্য এলে খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস নেওয়া দরকার। দেখা দরকার পরিবারে কোনো ত্রুটি আছে কি না। অথবা এর আগে তার আর কোনো শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মেছে কি না। সে ক্ষেত্রে আমরা কিছু কিছু ত্রুটিতে কাজ করতে পারি।
যেমন নিউরাল টিউব ডিফেক্ট যেটি, সে ক্ষেত্রে আমরা বলি বাচ্চা নেওয়ার তিন মাস আগে ফলিক এসিড খাও, এরপর বাচ্চা নাও। তাহলে আর নিউরাল নিউব ডিফেক্ট হবে না। হাইপোথাইরয়েড, সেখানে আমরা বলি, আয়োডিনযুক্ত খাবার খাও। তাহলে সমস্যা হবে না।
যদি রুবেলা নিয়ে একটি বাচ্চা জন্মায়, সেখানে কনজেনিটাল ক্যাটার্যাক্ট হতে পারে। বাচ্চার শ্রবণে অসুবিধা হতে পারে। তার হার্টে অসুবিধা হয়। সেখানে আমরা বলি তোমার যদি রুবেলা থাকে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা না থাকে একটি ভ্যাকসিন নিয়ে তার দুই মাস পরে গর্ভ ধারণ করবে। এ রকম কিছু কিছু জিনিস রয়েছে যেগুলো আগে থেকেই প্রতিরোধ করা যায়। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে তারপর গর্ভধারণ করতে হবে।
আর সমস্যা নির্ণয়ের জন্য আমরা ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে একটি আল্ট্রাসনোগ্রাফি করি। এই পরীক্ষা সবার করা উচিত। ওখানে যদি বড় ধরনের কোনো ক্রোমোজোমাল অস্বাভাবিকতা বাচ্চার থাকে, কিছু কিছু চিহ্ন দেখে বুঝতে পারি যে বাচ্চাটি ত্রুটিগ্রস্ত কি না।
এর পরের আল্ট্রাসাউন্ড করা হবে ২০ থেকে ২১ সপ্তাহের মধ্যে। মূলত ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে আমরা একটি অ্যানোমালিজ দেখি। সেখানে সম্পূর্ণ শরীরের অ্যানোমালিজ দেখি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনো সমস্যা আছে কি না সেটি দেখি।
এর মধ্যে প্রথম যে আল্ট্রাসনোগ্রাম করলাম, সেখানে যদি কোনো ত্রুটি থাকে বুঝতে পারি, সেখানে আমরা সিরাম টেস্ট করি। এই সিরাম টেস্ট করে আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। যদি দেখি ত্রুটি বাচ্চার ভেতরে আছে, সে ক্ষেত্রে আমরা ইনভেসিভ প্রসিজিওর করে নির্ণয় করতে পারি।
আর যদি গঠনগত সমস্যা হয়, যেমন পেটের দেয়াল তার ঠিকমতো হয়নি, তার মস্তিষ্ক ঠিকমতো তৈরি হয়নি, মাথার ভেতরে পানি রয়েছে, এমনকি তার চোখে ছানি আছে কি না, সেটিও কিন্তু আল্ট্রাসাউন্ড করে বোঝা সম্ভব।
প্রশ্ন : কী করলে এসব বিষয়গুলো প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর : আপন রক্তের সম্পর্কের কাউকে বিয়ে না করা। এটা আমাদের সবাইকে বলা উচিত গাইনোকোলজিস্ট হিসেবে আমি মনে করি। থেলাসেমিয়া যদি বংশে থাকে, সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো। আর ক্রোমোজোমাল ত্রুটিগুলো কিন্তু আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে যেতে পারে। কাজেই সেখানে আমাদের পরীক্ষার দরকার রয়েছে।
আমরা মনে হয় গর্ভধারণের আগে ফলিক এসিড সব মায়েরই খাওয়া উচিত। অন্তত দুই মাস খেয়ে এর পরগর্ভধারণ করা উচিত। এটি সবার ক্ষেত্রে। এরপর মাল্টিভিটামিন খাওয়া যাবে না। এতে ভিটামিন এ থাকে। এটি জন্মগত ত্রুটি তৈরি করতে পারে। ডায়াবেটিস যদি থাকে, খুব ভালো করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নয়তো শিশুর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। যদি কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকে, সে ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে ওষুধ দিতে হবে। নয়তো কিছু অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ রয়েছে, যেগুলো জন্মগত ত্রুটি তৈরি করে।
এসব রোগীদের খুব সর্তকতার সঙ্গে দেখতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে যদি চিকিৎসা দিই তাহলে সমস্যাগুলো নির্ণয় করতে পারি এবং পরামর্শ দিতে পারি। আমরা বলতে পারি এবং বুঝতে পারি শিশুটি জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মালেও সে বেঁচে থাকবে। তার কোনো সমস্যা হবে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জারি করে ঠিক করা যায়। সে পরামর্শও আমরা তাকে ওই মুহূর্তে করতে পারি।