মৃগীরোগের চিকিৎসা আছে কি?

মৃগীরোগ বা এপিলেপসি মস্তিষ্কের একটি জটিল রোগ। রোগটি নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৫৩তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ ওয়াহিদুর রহমান। বর্তমানে তিনি ডেল্টা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : এপিলেপসি একটি জটিল রোগ। শুরুতেই জানতে চাইব এপিলেপসি বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : মস্তিষ্কের নিজস্ব কিছু কাজ আছে, আচরণ আছে। ইলেকট্রিক্যাল অ্যাকটিভিটি রয়েছে মস্তিষ্কের। সেই ইলেকট্রিক্যাল কাজকর্ম সব সময় একই রকম যাচ্ছে। এই একই রকম প্রবাহের, কোনো সময়, এর মধ্যে যদি অস্বাভাবিক কিছু হয় বা ঠিকমতো না হয়, একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এপিলেপসি বলা হয়।
যদি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হয়ে যাওয়া যদি একসঙ্গে থাকে তাহলে একে মৃগীরোগ বা এপিলেপসি বলা হয়।
প্রশ্ন : কীভাবে রোগটি প্রকাশ পায়?
উত্তর : বিভিন্নভাবেই রোগটি প্রকাশ পেতে পারে। সব লোকের কিন্তু একই রকম হবে- এমন কোনো কথা নেই। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনি হওয়ার সঙ্গে আরো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আগের দিনে একটি ধারণা ছিল যে, ওই ব্যক্তির ওপর অশরীরী কিছু ভর করেছে।
হয়তো কেউ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খিঁচুনি হলো, মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে গেল, ঠোঁট বা জিহ্বা কেটে গেল, অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল, প্রস্রাব, পায়খানা করে দিল কাপড়ে- এগুলো লক্ষণ। মানুষ এটাই জানে।
এ ছাড়া হয়তো কথা বলছিল, বলতে বলতে কথা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। আবার ঠিক হয়ে গেল। একটা বাচ্চা লিখছে, লিখতে লিখতে হয়তো হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল বা আমি কথা বলতে বলতে হঠাৎ আনমনা হয়ে গেলাম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পড়ে গেলাম। আবার উঠে স্বাভাবিক হয়ে হেঁটে চলে গেলাম-এ সবই এপিলেপসির লক্ষণ।
এক কথায় বলা খুব মুশকিল, আসলে কোনটা হবে। তো যেটাই হোক, মস্তিষ্কের যে স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি। তার যেই ইলেকট্রিক্যাল স্বাভাবিক কার্যক্রম, এর যখন অস্বাভাবিকতা হয়, সেটাই মৃগীরোগ হিসেবে প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন : এই জাতীয় সমস্যা হলে আপনাদের কাছে যখন রোগীরা যায়, তখন আপনাদের ব্যবস্থাপনা কী থাকে?
উত্তর : প্রথমে আমরা দেখি, তার পারিবারিক ইতিহাস কী রকম। পরিবারে থাকতে পারে। হয়তো তার ভাইবোন, চাচা-ফুফু, খালা-মামা এদের কারো থাকতে পারে। তারপর কতদিন ধরে সমস্যাটি হয়েছে সেটা জানি। একবার হওয়ার পর আরেকবার যখন হয়- এর বিরতিটা কী রকম- এগুলো জানি।
এমন অনেক সময় হয় যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর দেখা গেল সব স্বাভাবিক। তখন রোগীরা বলে, ‘সবই স্বাভাবিক, আপনি বলছেন মৃগীরোগ।’ তখন রোগীদের সঙ্গে অনেক সময় মতের ভিন্নতা দেখা দেয়। বিশেষ করে যেগুলোর কারণ জানা যায়নি সেগুলোর সব পরীক্ষা করে দেখা গেল স্বাভাবিক। কিন্তু আসলে মৃগীরোগ। তাই ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : রোগীটি কতখানি জটিলতা তৈরি করতে পারে?
উত্তর : কিছু কিছু আছে হয়তো দুই থেকে তিন বছর পর একবার হচ্ছে। আর কতগুলো দিনের মধ্যে তিন থেকে চারবার করে হচ্ছে। এটা নির্ভর করে কোন রোগের কারণে হচ্ছে এবং চিকিৎসাটা সঠিক হচ্ছে কি না -সেটার ওপর।
আর রোগ নির্ণয় করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে অন্য রোগের বিভ্রান্তি হতে পারে। যেমন : হিস্টিরিয়া বলে একটি রোগ আছে। এটিও একই রকম লক্ষণ প্রকাশ করে। সে জন্য ইতিহাস দেখে ভালো করে শুনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এরপর যদি দেখা যায়, ঠিকমতো চিকিৎসা শুরুই হলো না বা ওষুধ ঠিক দেওয়া হলো না। আবার ওষুধ মাঝপথে বন্ধ করে দিল। দেখা গেল, ছয় মাস ওষুধ খাওয়ার পর ভালো আছে। এরপর ওষুধ সে নিয়মিত না খেয়ে বন্ধ করে দিল। তখন এই রোগ আরো জটিল আকারে, আরো বেশি বেশি করে হওয়া শুরু করে।
প্রশ্ন : তবে আমরা কিন্তু দেখি এই জাতীয় রোগগুলোকে রোগীরা সাধারণত লুকিয়ে রাখে, প্রকাশ করতে চায় না। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
উত্তর : এই বিষয়ে একটি প্রচলিত বিশ্বাস আছে। ধরেন একজন মেয়ের এই রোগ আছে। যদি ওই এলাকায় এটা জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে তো মেয়েটার বিয়ে হবে না। এই জিনিসগুলো সে জন্য লুকিয়ে রাখে।
অনেকে মানতে চায় না তার মৃগীরোগ আছে। আমি যদি বলি ‘আপনার মৃগীরোগ আছে, সে বলে, আপনি কী বলেন ডাক্তার সাহেব? এটি মৃগীরোগ নয়। স্বীকার করতে চায় না। এই যে নেতিবাচক বিষয়, এই বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। চিকিৎসা আছে। ভয়ের কিছু নেই। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করতে হবে।
প্রশ্ন : সঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে কতটুকু ফল পাওয়া যায়?
উত্তর : সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে। ঠিক চিকিৎসা যদি হয়, ঠিক সময়ে, ঠিক ওষুধ, ঠিক ডোজে খেতে হবে। চিকিৎসার কোর্স পূর্ণ করতে হবে। তাহলে রোগী সুস্থ হবে।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের কি কোনো বিষয় আছে?
উত্তর : যে কারণের জন্য এই রোগ হচ্ছে, সেগুলো প্রতিরোধ করা যায়। যদি মস্তিষ্কের টিউমারের জন্য হয়, এটি অস্ত্রোপচার করলে ভালো হয়ে যায়। সংক্রমণের কারণে যদি হয়, সেগুলো চিকিৎসা করলে ভালো হয়ে যাবে।
আর যেগুলোর কারণ জানা যায়নি, সেগুলোর খুব বেশি প্রতিরোধ নেই। এ ক্ষেত্রে ওষুধ খেতে হবে। বিপজ্জনক জায়গায় যাওয়া যাবে না। আশপাশের লোকের জানা থাকতে হবে তার এপিলেপসি আছে।