অ্যাজমার চিকিৎসা কী

অ্যাজমা একটি বহুল প্রচলিত রোগ। তবে বর্তমানে এর অনেক আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। এ নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৫৫তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস। বর্তমানে দ্য অ্যালার্জি অ্যান্ড অ্যাজমা সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
প্রশ্ন : অ্যাজমা রোগ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি?
উত্তর : অ্যাজমা রোগ সাধারণ অ্যালার্জি জনিত রোগের একটি অংশ। ছোটো থেকে বৃদ্ধ- যেকোনো বয়সেই এটি হতে পারে। অ্যাজমা হলে শ্বাসকষ্ট হয়, কাশি হয়। বাঁশির মতো আওয়াজ হয়। রাতে ঘুমাতে পারে না। ঘুম ভেঙ্গে উঠে যায়। এ রকম হলে আমরা বুঝি রোগী শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমাতে ভুগছে।
প্রশ্ন : সাধারণত কারা বেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়?
উত্তর : ছোট থেকে বড়- সব বয়সেই হয়। তবে বাচ্চাদের সাধারণত বেশি হয়।
প্রশ্ন : অ্যাজমা রোগের কারণ কী?
উত্তর : অ্যাজমা রোগের অন্যতম একটি কারণ অ্যালার্জি। এই অ্যালার্জিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাড়িঘরের পুরোনো ধুলাবালি। যেমন : বিছানার চাদর, ঘরের ঝুল, অনেক দিন আলামারিতে রাখা কোনো জামা কাপড়- এগুলো এক ধরনের ধুলা হয়। একে বলে মাইট। এগুলো হলো অন্যতম। এ ছাড়া ফুলের রেণু, ফাঙ্গাস, কিছু খাবার- এগুলো সাধারণত অ্যালার্জির কারণ।
প্রশ্ন : অ্যাজমা রোগী যখন আপনাদের কাছে আসে, তখন কী ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসে? শুধুই কি শ্বাসকষ্ট?
উত্তর : শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে। অনেক সময় এর সাথে দেখা যায়, তার নাকে সর্দি পড়ছে, হাঁচি হচ্ছে, চোখ চুলকানি হচ্ছে। কারো ক্ষেত্রে আবার শরীরে চাক চাক হয়ে যাওয়া- এসব ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসতে পারে। অনেক সময় একক রোগ নিয়ে আসতে পারে, কখনো আবার অনেক একসাথে নিয়ে আসতে পারে।
প্রশ্ন : এই জাতীয় সমস্যা নিয়ে এলে আপনারা রোগীকে কী ধরনের পরামর্শ দেন?
উত্তর : প্রথম আমরা কিছু পরীক্ষা -নীরিক্ষা করি। নিশ্চিত হই তার কিসে অ্যালার্জি।
প্রশ্ন : একেক জনের কি একেক বিষয়ে অ্যালার্জি থাকে?
উত্তর : হ্যাঁ, একেক জনের একেক বিষয়ে অ্যালার্জি থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, এ সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে সে হয়তো কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে দেয়। তবে বিশ্বব্যাপী কিন্তু চিকিৎসার ধারা পরিবর্তন হয়ে গেছে।
যেমন প্রথমেই অ্যালার্জি পরীক্ষা করতে হবে। এটা আবার দুইভাবে করা যায়। হাতের মধ্যে একটি স্কিন পিক টেস্ট। আরেকটি স্পেসিফিক আইজি। যেকোনো ভাবেই পরীক্ষা করার পর যে অ্যালার্জেন পাওয়া যাবে, সেই জিনিসটিকে প্রথমে পরিহার করতে হবে।
একটি বাইরের উপাদান নাকে বা ফুসফুসে আইজিইর সাথে, এক সাথে মিলে মারসেলকে ভাঙ্গে, প্রদাহ হয়ে আমাদের শ্বাসকষ্ট তৈরি হয়। আইজিই কে কনভার্ট করে আইজিজি করতে হয়, ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে, অ্যালার্জি ভ্যাকসিন। আরেকটি হলো, স্টেরয়েড ইনহেলার, মন্টিলুকাস দিয়ে আমরা চিকিৎসা করি। আর হলো রোগীদের সচেতনতা তৈরি করা। যেমন : যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম।
আমাদের কাছে কিছু রোগী আছে যাদের কোনো অ্যালার্জি নেই। কিন্তু দেখা যায়, পরীক্ষা এলেই রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়ে যায়। এগুলো সব হলো মানসিক চাপ। অনেক রোগীই এমন রয়েছে।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে আপনারা কী করেন?
উত্তর : এসব ক্ষেত্রে আমরা যতই ওষুধ দেই না কেন মানসিক চাপ যদি না কমাই, তাহলে শ্বাসকষ্ট কোনো দিন কমবে না। এই ক্ষেত্রে আমরা ওষুধের পাশাপাশি তাকে ধ্যান, প্রাণায়াম- এসব ব্যায়ামও শেখাই। যখন এগুলো সে রপ্ত করতে পারে, ভালো হয়। দেখা যায় তার অ্যাজমাও চলে যায়।
প্রশ্ন : আমরা কিন্তু দেখি, যাঁরা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তাঁদের হঠাৎ করে যেকোনো সময় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে যদি এই সমস্যা হয় কী করা উচিত?
উত্তর : এই জন্য আমরা বলি সবসময় তাকে হাতের কাছে ইনহেলার রাখতে হবে, সালবিউটামল গ্রুপের। এটা প্রথমে একবার নিল। না কমলে প্রতি মিনিটে একবার করে নিতে হবে। যদিও অনেকে বলে তিন চার বারের বেশি দেওয়া যাবে না। এটা ঠিক নয়। প্রতি মিনিটে একবার করে পাঁচ ছয়বার নিবে। তারপর হয়তো দুই মিনিট পরপর, পাঁচ ছয় মিনিট পরপর নিবে- এতে তার অনেকটা স্বস্তি হবে।
প্রশ্ন : ইনহেলার ব্যবহার করতে অনেকেই অনাগ্রহ দেখান। অনেক রোগীর ধারণা একবার ইনহেলার নিলে সারাজীবন নিতে হবে। এটি নেওয়া মানেই সারা জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকা। কী বলবেন এই ক্ষেত্রে?
উত্তর : এটি কিন্তু ঠিক নয়। রোগীদের যে ধারণাটা অমূলক তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে একবার নিলে অনেকদিন নেয়। যদি কোনো রোগী পরীক্ষা করার পর অ্যালার্জেন পরিহার করে, ইমিউনোথেরাপি নেয়, ব্যায়াম করে- এরপর দেখা যায় রোগের পরিমাণটা কমে যায়। যখনই তার ফুসফুসে, নাকে প্রদাহ কমে যায়, তখন আর ইনহেলার লাগে না। সারাজীবন যে ইনহেলার নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এভাবে ইনহেলারের প্রয়োজনীয়তা আস্তে আস্তে কমিয়ে দেই।
প্রশ্ন : জীবন যাপনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কী কী ধরনের পরামর্শ দেন?
উত্তর : আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশে যেসব অ্যাজমা রয়েছে, এর অন্যতম কারণ অ্যালার্জি। অ্যালার্জির অন্যতম কারণ হাউজ ডাস্ট মাইট। বাড়িঘরের ধুলাবালির মধ্যে যেটা থাকে। এই জন্য আমরা বলি, ঘর যখন ঝাড়ু দেবে ওই রোগী ওই রুমে থাকবে না। এরপর তার বিছানার চাদর প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হবে। পারলে তোষক, বালিশ মাঝে মাঝে রোদে শুকাতে দিতে হবে। কারণ একটি তোষকের মধ্যে হাউজ ডাস্ট মাইট থাকে ২০ লাখের উপরে। এগুলো নাক দিয়ে যত কম যাবে, হাঁচি, শ্বাসকষ্ট তত কম হবে।
শীত এলে শীত বস্ত্র আলামারি থেকে বের করেই সাথে সাথে গায়ে দেওয়া ঠিক নয়। একে হয় ধুয়ে নিতে হবে নতুবা রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এগুলো করলে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়। আর যাদের ফুলের রেণু থেকে অ্যালার্জি হয়, ফুলের ওই ঋতু অনুযায়ী একে পরিহার করতে হবে। অনেকের ফাঙ্গাস থেকে হয়। বাথরুমের স্যাঁত স্যাঁতে ভাব পরিহার করতে হবে।
অনেকের ধারণা অ্যাজমা হয়েছে- গরুর মাংস, চিংড়ি, পুটি, বোয়াল, শোল, গজার বাদ দিয়ে দেয়। আমার আজকে ২০ বছরে অভিজ্ঞতায় দেখেছি গরুর মাংসে অ্যালার্জি এক থেকে দুই ভাগ মাত্র। যার গরুর মাংসে অ্যালার্জি নেই, তার খেলেও যা না খেলেও তা। অনেকের আবার আলুতে অ্যালার্জি হয়। অনেকের দেখা যায় টমেটোতে অ্যালার্জি।
প্রশ্ন : অনেক ক্ষেত্রে অপরিচিত অ্যালার্জেন থাকে। সেগুলো কী বের করার কোনো উপায় রয়েছে?
উত্তর : আমরা যেমন ৬০/৭০ টা অ্যালার্জেন পাই যেটি খুব প্রচলিত। এর পর আমরা রোগীদের বলি কোনো খাবার খেলে যদি কোনো উপসর্গ বাড়ে, একে এড়িয়ে যেতে হবে। সব খাবারেই যে অ্যালার্জি হবে সেটি নয়।
প্রশ্ন : অ্যাজমার যদি চিকিৎসা করা না হয় কী জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : জটিলতা অনেক রয়েছে। এমনকি অ্যাজমা হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। আগে কিন্তু অ্যাজমাতে অনেক রোগী মারা যেত। এখন উন্নত চিকিৎসায়, বিশেষ করে ইনহেলার আসাতে অনেক ভালো হয়েছে। রোগী যদি ঠিকমতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেয় তাহলে ভালো থাকতে পারে। এখন অ্যাজমা হয়ে মৃত্যু নেই বললেই চলে।