গরমে শিশুর সমস্যা, প্রতিকারের উপায়

গরমে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। এর মধ্যে ডায়রিয়া, মামস, ঠান্ডা জ্বর ইত্যাদি রয়েছে। এসব নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৮৯তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মেসবাহ উদ্দীন। বর্তমানে তিনি গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : গ্রীষ্মকালে শিশুদের কী কী সমস্যা হয়ে থাকে?
উত্তর : গ্রীষ্মকাল চলছে, প্রচণ্ড গরম বাইরে, এর মধ্যে আমাদের শিশুদের ডায়রিয়া হচ্ছে অনেক। ছোট শিশুদের কিছুটা ব্রঙ্কিওলাইটিসের মতো হচ্ছে। ঠান্ডা কাশি এবং অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণও এখান দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, টাইফয়েডেরও প্রাদুর্ভাব হয়েছে।
আর ভাইরাল সংক্রমণের ভেতর প্রচলিত ঠান্ডা (কমন কোল্ড) আছে। একটা জিনিস কিছুদিন থেকে ঢাকা শহরে লক্ষণীয়, যেমন—বিশেষ করে আমরা যাঁরা প্র্যাকটিস করি, তাঁরা দেখছি, প্রতিদিন মামসের বাচ্চা আসছে। মামসের সমস্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি। এই প্রাদুর্ভাব হওয়ার পেছনে সঠিক কারণটি বলতে পারব না, তবে এবার একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। এই সপ্তাহে আমি প্রায় পাঁচ থেকে সাতটি মামসের বাচ্চা দেখেছি। মামসের ক্ষেত্রে বাচ্চাগুলোর প্রথম দিকে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। ঠান্ডা, হালকা জ্বর, একটু গায়ে ব্যথা, মাথায় ব্যথা থাকে। যখনই তাদের গলাটা একটু ফুলল, তখনই পিতা-মাতা সতর্ক হন।
প্রশ্ন : ঠিক গ্রীষ্মকালেই কেন এ সমস্যা হচ্ছে?
উত্তর : সামার ডায়রিয়া (গ্রীষ্মকালীন ডায়রিয়া) বলে একটি জিনিস রয়েছে। বাচ্চারা খুব ক্লান্ত থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের পানীয় খায়। এর মধ্যে বাইরের পানীয় আছে। শহরে অনেক পানীয় বাইরে বিক্রি হয়, খোলা জায়গায় বিক্রি হয়। স্কুলগামী শিশুরা, বিশেষ করে মা-বাবার কাছে বায়না ধরে খেয়ে ফেলে। এগুলো থেকে তাদের ডায়রিয়া হচ্ছে। পরে দেখা যায়, কিছুদিন পর টাইফয়েড হচ্ছে।
গরমের মধ্যে অনেক সময় খাবার হজম হয় না। খাবারগুলো যদি বাইরের খাবার হয়, তাহলে আরো বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আমরা যাঁরা শহরকেন্দ্রিক প্র্যাকটিস করি, এগুলো বেশি দেখে থাকি।
আইসিডিডিআরবিতে দেখা যায়, প্রচুর বয়স্ক লোক, সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। আমার জানামতে, আইসিডিডিআরবিতে এখন স্থান দেওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তারা বাইরে ক্যাম্প করে চিকিৎসা করছে। এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ লোক বলছে, কলেরাও হচ্ছে পাশাপাশি।
প্রশ্ন : কোন সময় চিকিৎসকের কাছে যাবে এমন সমস্যা হলে?
উত্তর : আসলে এটি খুব জটিল প্রশ্ন। মামসের ক্ষেত্রে আমি অনেক বাচ্চার অর্কাইটিস পেয়েছি। তো অর্কাইটিস তো একটি জটিল বিষয়। পিতা-মাতা বুঝতে পারেন না। মামসটা স্কুলগামী শিশুদের বেশি হয়। তারা সংক্রমণ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। হাঁচি, কাশি কথাবার্তার সঙ্গে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
মামসের ফোলা কমে যাওয়ার তিন-চার দিনের মধ্যে সংক্রমণটা চলে যায়। তার আগেই কিন্তু জিনিসটি সে ছড়িয়ে ফেলছে। এ জন্য মা-বাবার বোঝা মুশকিল যে কখন তারা চিকিৎসকের কাছে যাবে। আবার কিছু কিছু মামসে লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ২০ শতাংশ তার কোনো লক্ষণ থাকবে না, তবে সে মামসে ভুগছে।
প্রশ্ন : মামসের ক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : মামস হয়ে গেলে কী করণীয়, সেটা বলি। মামস হয়ে গেলে শিশুকে সাধারণত স্কুলে যেতে না দেওয়াই ভালো। পরীক্ষার সময় দেখা যায়, শিশুদের স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। শিক্ষকরা কিন্তু জানলে যেতে মানা করে। ঢাকা শহরে লেখাপড়ার একটি প্রতিযোগিতার চাপও বাচ্চাদের ওপর প্রচণ্ড। এ ক্ষেত্রে মামস হয়ে গেলে যেটা আমরা বলি, এটা একটি ভাইরাল রোগ। ওষুধের মধ্যে প্যারাসিটামলই সবচেয়ে ভালো ওষুধ। তাকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্যারাসিটামল দিতে হবে। তাকে প্রচুর পরিমাণ পানীয় খাওয়ানো, মুখমণ্ডলের যত্ন করা। আমরা বলি, ঘরে তৈরি তরল খাবার দেন।
প্রশ্ন : এ ছাড়া অন্যান্য যে সমস্যা হচ্ছে সেগুলো সম্বন্ধে বলেন?
উত্তর : ডায়রিয়া হচ্ছে। ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে তারা যেন বাইরের খাবারগুলো পরিহার করে। মা-বাবা যেন বাচ্চাদের হাত ধোয়া অভ্যাস করায়। হাত ধোয়ার বিষয়টি আমাদের দেশে অভ্যাস কম।
আইসিডিডিআরবির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ বাসায় হাত ধোয়ার মতো পর্যাপ্ত বিষয় আছে। কিন্তু মাত্র ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এটি প্র্যাকটিস করি। বিশ্বে কিন্তু হাত ধোয়া দিবস পালিত হচ্ছে। এটা প্রতিদিনই পালন করতে হবে। একটি দিনকে শুধু হাত ধোয়া দিবস নয়, প্রতিদিন পাঁচবেলা হাত ধুতে হবে। খাবারের আগে যে ভালো করে হাত ধুই।
আর হাত ধোয়ার বিষয়টি সম্পর্কে আমরা ভালো করে জানিও না। স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের একটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বাচ্চাদের শেখানো হাত ধোয়ার বিষয়ে।
কীভাবে বাইরের খাবার থেকে শিশুরা দূরে থাকবে এবং ঘরের তৈরি খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হবে। এই জিনিসগুলো সবার খেয়াল রাখা উচিত। পিতা-মাতা এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত।
আর ডায়রিয়া হয়ে গেলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওআরএস, খাবার স্যালাইন খেতে হবে। যদি বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে তো চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডায়রিয়ায় সাধারণত কোনো অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না।
অনেক সময় ভাইরাল জ্বরের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেয়। এটা পক্ষান্তরে তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এটি ভাইরাল জ্বর। সে ক্ষেত্রে আমি যদি কেবল প্যারাসিটামল দিই, তাহলে হয়। আর অ্যান্টিবায়োটিক দিলে অন্যান্য অসুখের জন্য রেজিসটেন্স তৈরি হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, দু-তিন দিন মা-বাবা ঘরেই চিকিৎসা দিতে পারেন। যদি তাঁদের প্যারাসিটামল সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা থাকে। এক বছরের একটি বাচ্চাকে আমরা এক চামচ করে চারবেলা প্যারাসিটামল দিতে বলি। গা মুছে দেন, মাথায় পানি দিয়ে দেন।
দুই বছরের বাচ্চাকে দেড় চামচ, তিন বছরের বাচ্চাকে দুই চামচ দিতে বলি। এভাবে ডোজটা ঠিক রাখলে পিতা-মাতা অনায়াসে বাচ্চাকে বাসায় রাখতে পারে। নয়তো অনেক চিকিৎসকের কাছে গেলেই দেখা যায় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন। এতে বাচ্চাদের ক্ষতি হয়।
হয়তো টাইফয়েড হলো, বাচ্চাকে আগেই পরীক্ষা না করে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিল, পরে কিন্তু টাইফয়েডটা ভালো করে বোঝা যাবে না। এতে চিকিৎসা ব্যাহত হবে।
মা-বাবার প্রতি আমার অনুরোধ, প্রতিরোধই উত্তম। অসুখ-বিসুখ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় পরিমাপে খাবার দেওয়া।
আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন বর্তমানে ওজনাধিক্য একটি বড় সমস্যা বাংলাদেশে। সর্বোপরি আসলে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।