প্রথম পাঁচ দিন জলবসন্ত ছোঁয়াচে!

শিশুদের বিভিন্ন রকম চর্মরোগ হয়ে থাকে। এসব রোগ অনেক সময় ছোঁয়াচে হয়। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৪০৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মো. রেজা বিন জায়েদ। বর্তমানে তিনি অরোরা স্কিন অ্যান্ড এনস্টেটিকস সেন্টারের চর্মরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : শিশুদের চর্মরোগ বলতে আমরা কোন ধরনের রোগকে বুঝি?
উত্তর : আসলে শিশুদের চর্মরোগ বড়দের মতোই অনেকটা। বিশেষ কিছু চর্মরোগ শিশুদের ক্ষেত্রে বারবার হয়ে থাকে। আমরা মূলত একে তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি। ব্যাকটেরিয়াজনিত, অর্থাৎ এক ধরনের বিশেষ ব্যাকটেরিয়া স্টেফাইলোকক্কাস। এই জীবাণু বাচ্চাদের বেশি আক্রান্ত করে। বিশেষ করে গরমকালে এটা দেখা যায়। এদিক-সেদিক ছোট-বড় ফোঁড়ার মতো হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঘায়ের মতো ক্ষত সৃষ্টি হয়ে পানি ঝরছে, একটু ভেজা ভেজা, ব্যথা অনুভব হয়। এসব ঘা হয়। মুখে ও চোখের চারপাশে বেশি হয়। এগুলো স্টেফাইলোকক্কাসজনিত চর্মরোগ।
আবার আরেক ধরনের চর্মরোগ, বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। ভাইরাসজনিত। একে আমরা আঁচিল বলি বাংলায়। অথবা আমাদের ভাষায় মোলাস্কাম কন্টাজিওসাম। এই ধরনের চর্মরোগ ছোঁয়াচে এবং আগে যেই ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের কথা বললাম, সেটাও ছোঁয়াচে। কিন্তু এটা বাচ্চাদের থেকে বাচ্চাদের মধ্যেই যায়। বড়দের যায় না।
আমি যা বলছিলাম, আঁচিল বা মোলাস্কাম কোন্টাজিয়াস। এটি অনেকটা সাদা, ছোট গোটার মতো। এর মাথায় একটা ছোট গর্ত মতো দেখা যায়। একে বলা হয় আম্বিলিকেশন। আমরা সেটা দেখে সমস্যাটি বলতে পারি। তা ছাড়া ভাইরাসজনিত রোগ তো বাচ্চাদের অনেক কিছুই আছে।
একটি ঋতু যায়, যখন জলবসন্ত বেশি হতে থাকে। একে আমরা বলি ভেরিসিলার জোসটার। যদি ভেরিসিরাল জোস্টারের টিকা না দেওয়া থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে বেশি হতে থাকে। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছরের ভেতরে ভেরিসিলার জোস্টার হয়।
আরো কিছু রোগ আছে, যেটা ব্যাকটেরিয়াও নয়, ভাইরাসও নয়। সেগুলো এমনি এমনি হয়। যেমন অ্যাকজিমা। অ্যাকজিমা অন্য কারণে হয়ে থাকে। বাচ্চাদের অ্যাকজিমার প্রকোপ খুবই বেশি। বিশেষ করে, এটোপিক ডার্মাটাইটিস। এই রোগে বাচ্চারা সাধারণত বেশ কান্নাকাটি করে। অস্বস্তিতে থাকে। এই অ্যাকজিমাটা মুখে, হাতে ও কোনো কোনো ভাঁজ ভাঁজ জায়গায় হয়। অতিরিক্ত চুলকায় বলে শিশু বিরক্ত হয় এবং কান্নাকাটি করে। এটোপিক ডার্মাটাইটিস যাদের হয়, এখানে কিন্তু ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস দিয়ে আর বিশ্লেষণ করা যায় না। এটা অনেক সময় বংশগত কারণেও হয়। অনেক সময় অ্যালার্জির কারণে হয়ে থাকে। মূলত এসব রোগ বাচ্চাদের বেশি দেখা যায়।
প্রশ্ন : কত বয়সের বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগগুলো বেশি দেখা যায়?
উত্তর : আসলে পেডিয়াট্রিক একটি বয়স আছে। এই বয়সকে এখন ধরা হয় ২০ বছরের ভেতরে। আসলে পেডিয়াট্রিক বয়সেই এ সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায়। আমরা যদি এ বয়সকে আরো ভাগ করি, নিউনেটাল এইজ, এরপর চাইল্ডহুড এইজ এগুলো ইচ্ছা করলে ভাগ করা যায়। অনেকে এভাবেই ভাগ করে। প্রথম দুই বছর, এর পর দুই বছর থেকে সাত বছর। এভাবেও ভাগ করে। যাহোক মূলত পেডিয়াট্রিক এইজ মানে ২০ বছরের ভেতরে।
প্রশ্ন : এসব রোগের লক্ষণগুলো কীভাবে প্রকাশ পাবে?
উত্তর : ব্যাকটেরিয়াজনিত যেটা হয়ে থাকে, এর সঙ্গে কিন্তু জ্বর হতে পারে। এই জ্বর সামান্য হয়ে থাকে। যেই জায়গাটায় ব্যাকটেরিয়া হয়, যাকে আমি বয়েল বলছি বা ফারাঙ্কাল বলছি, সবই ব্যাকটেরিয়ার কারণে। এর সঙ্গে ওই জায়গাগুলোতে ব্যথা হয়ে থাকে। আমরা যদি চিকিৎসা না করে এর পেছনে সময় দিতে থাকি, তাহলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বা সেরেই যায়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই বড় ফোঁড়া আকারে হয়ে যায়। ওখান থেক পুঁজ ইত্যাদি বের হয়। বাচ্চারা বিষয়টিতে ভুগতে থাকে। একটি জায়গা থেকে আরেকটি জায়গায় ছড়াতে থাকে। তখন যতক্ষণ না অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, ততোক্ষণ পর্যন্ত এটা নিয়ন্ত্রণে আসে না।
একটি ভাইরাস যেমন মোলাস্কাম কোন্টাজিয়াসাম, এখানে কোনো লক্ষণ থাকে না। জ্বর থাকে না। বাচ্চা একেবারে সুস্থ থাকে। কিন্তু দিন দিন এই দানাগুলো বাড়তে থাকে। কোনো ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়। পরে ব্যাকটেরিয়া সুযোগ বুঝে সেখানে ঢুকে পড়ে। তখন সেই সময়ে লক্ষণ তৈরি করতে থাকে। এই মোলাস্কাম কোন্টাজিয়াসামের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি আছে। সবচেয়ে ভালো হয় ক্রায়োথেরাপি নামক এক ধরনের ঠান্ডা তরল নাইট্রোজেন গ্যাস দিয়ে ওর ওপরে ছিটিয়ে দিলে। ওটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কোনো কোনো সময় এক ধরনের রাসায়নিক ওষুধ আছে, সেটা যদি সেই জায়গাটায় ধরা হয়, সেটি মরে যায়। ভাইরাস সেখান থেকে চলে যায়।
এ ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো তেমনভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না। তবে সব ভাইরাসে যে প্রকাশ পাবে না, সেটি নয়। আমি একটু আগেই বলছিলাম যে ভেরিসিলার জোস্টার। যেটা জলবসন্ত। এর কিন্তু লক্ষণ আছে। জ্বর থাকে। প্রচণ্ড চুলকাতে থাকে, গা-হাত-পা খুব ব্যথা করে, প্রথম পাঁচ দিন এটা খুব ছোঁয়াচে। এটা একটু খেয়াল রাখতে হবে। সে সময় বাচ্চাকে আলাদাভাবে রাখাই ভালো। কারণ, ঘরে অন্যান্য বাচ্চা থাকলে তাদের গায়ে ছড়ানোর সুযোগ থাকে।
আমাদের অনেকের ধারণা, যখন জলবসন্ত শুকাতে থাকে, চোঁচা উঠতে থাকে, তখনই মনে করা হয় রোগটি ছড়ায়। তাকে আলাদা করে রাখা হয়। আসলে সেটি নয়। জলবসন্ত ওঠার পর থেকে প্রথম পাঁচ দিন হলো ছোয়াঁচে। এই সময় আইসোলেশন বা আলাদাভাবে রাখতে হবে।
এই আইশোলেশন (আলাদাভাবে রাখা) কাকে বলে? মশারি দিয়ে রাখাটা ভালো। আলাদা ঘরে রাখা ভালো। তার ব্যবহার্য থালা, বাটি, কাপড়চোপড় না ব্যবহার করাই ভালো। একে আইশোলেশন বলে। এতে অন্য কেউ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে আসে।
আমাদের ন্যাশনাল ইপিআই, টিকা কর্মসূচিতে, কিন্তু ভেরিসিলার জোস্টার নেই। সুতরাং কেউ যদি ভেরিসিলার জোস্টারের টিকা দিয়ে থাকেন, তাহলে ভালো। এভাবেও রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। তবে যাদের একবার এই জলবসন্ত হয়ে যায়, তার ক্ষেত্রে টিকার হয়তো বা প্রয়োজন হয় না। কেননা, পরে জলবসন্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। কারণ, এই জলবসন্ত নিজেই এক ধরনের ভাইরাস আগেই বলছিলাম। এই ভাইরাস শরীরে ঢোকার পরে আমাদের শরীর নিজে থেকে প্রতিকার তৈরি করে ফেলে জলবসন্তের জন্য।