মাইক্রো প্লাস্টিক কীভাবে এটি মানবদেহে প্রবেশ করে? কী কী প্রভাব ফেলে?
সমুদ্র তলদেশ থেকে শুরু করে অতিকায় পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়া সর্বত্র পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। জলবায়ু ও পরিবেশকে গ্রাস করে ফেলায় প্রাণীজগতের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নগণ্য কণাগুলো। এই আশঙ্কা থেকে মানুষও মুক্ত নয়, বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোর গবেষণায় মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে এই কণাগুলোর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণেই মানব স্বাস্থ্যের ওপর এই ক্ষুদ্র কণাগুলোর প্রভাব সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানা জরুরি। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক, কী এই মাইক্রো প্লাস্টিক, মানবদেহে কীভাবে এর অনুপ্রবেশ ঘটে, আর এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলোই বা কী?
মাইক্রো প্লাস্টিক কী
প্লাস্টিকের যেসব কণার আকার ৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের কম, সেগুলোকে মাইক্রো প্লাস্টিক বলা হয়। এগুলো পাওয়া যায় পোশাক, প্রসাধনী, খাদ্যের মোড়ক এবং শিল্প কারখানায় নানা ধরনের প্রক্রিয়ার উৎপাদ হিসেবে। মূলত উচ্ছিষ্ট হিসেবে উদ্বৃত্ত হয়ে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশ করে এগুলো পরিবেশকে দূষিত করে থাকে।
মাইক্রো প্লাস্টিক প্রধানত প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি- এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রাইমারি পর্যায়ের টুকরোগুলো পরিবেশে প্রবেশের আগে থেকেই ৫ মিলিমিটার বা তার কম আকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে পোশাকের ক্ষুদ্র সুতা, ক্ষুদ্র গুটিকা, প্লাস্টিকের গ্লিটার ও প্লাস্টিকের প্যালেট বা নার্ডল্স।
অন্যদিকে, সেকেন্ডারি মাইক্রো প্লাস্টিকগুলো পরিবেশে প্রবেশের পর প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বড় প্লাস্টিক পণ্যগুলোর ভাঙন থেকে সৃষ্টি হয়। যেমন পানি ও সোডার বোতল, মাছ ধরার জাল, প্লাস্টিকের ব্যাগ, মাইক্রোওয়েভ পাত্র, টি-ব্যাগ ও টায়ারের আবরণ।
উভয় ধরনের কণাই যেকোনো বাস্তুতন্ত্রের উচ্চ স্তরে টিকে থাকতে পারে। বিশেষ করে জলজ ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে এগুলো পানি দূষণের কারণ হয়। মহাসাগরীয় মাইক্রো প্লাস্টিকের ৩৫ শতাংশ আসে টেক্সটাইল বা পোশাক শিল্প থেকে। এই আগ্রাসনটি প্রাথমিকভাবে পলিয়েস্টার, এক্রিলিক বা নাইলন-ভিত্তিক পোশাকের ক্ষয়জনিত কারণে হয়ে থাকে। এ ছাড়া বায়ু ও ভূমিক বাস্তুতন্ত্রেও এই আগ্রাসন লক্ষণীয়।
প্লাস্টিকের ক্ষয় প্রক্রিয়া বেশ ধীর গতির; অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাজার বছর লেগে যায়। তাই এগুলোর উচ্ছিষ্ট কণাগুলো কোনো জীবের দেহে একবার প্রবেশ করলে দীর্ঘদিন ধরে সেখানেই থেকে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরকম আরও প্লাস্টিক কণার অনুপ্রবেশের কারণে দেহের অভ্যন্তরে জমা হতে থাকে। বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো নদী বা সমুদ্র যেকোনো জলাধার থেকে খাদ্য শৃঙ্খলে ঢুকে পড়ে, যার বিস্তৃতি ঘটে প্রাণীদেহ পর্যন্ত।
মাইক্রো প্লাস্টিক মানবদেহে কীভাবে প্রবেশ করে
১. আহার বা পানের মাধ্যমে
অন্যান্য জীবাণুর মতো এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাও যেকোনো খাবার খাওয়া বা পানীয় পানের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। যেমন দীর্ঘ দিন ধরে প্লাস্টিকের পাত্রে সঞ্চিত খাবার কিংবা তাতে গরম করা খাবারে মাইক্রো প্লাস্টিক থাকতে পারে। পুরোনো প্লাস্টিকের গ্লাস এবং নিত্য ব্যবহৃত টুথপেস্ট বা টুথব্রাশও এই কণাগুলোর সহায়ক উৎস।
মোটা দাগে এ ধরনের কণা ধারণকারী মাটিতে শস্য চাষ করা হলে তা থেকে উৎপাদিত ফসল স্বাভাবিকভাবেই দূষিত থাকবে। সেই সূত্রে অধিকাংশ শস্য খাদ্যই মাইক্রোপ্লাস্টিক দ্বারা দূষিত। গম ও লেটুসে যথেষ্ট পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।
প্লাস্টিকের বোতলের খাবার পানি যে পরিমাণ প্লাস্টিক কণা থাকে, তা সরাসরি ট্যাপ বা কলের পানির তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এমনকি বিভিন্ন মোড়কে বিক্রি করা কোমল পানীয়তেও এসব ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে।
এ ছাড়া সেঁচের পানি এবং জমিতে সার ছিটানোর সরঞ্জামেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বিদ্যমান। এতে করে সংশ্লিষ্ট জমি থেকে উৎপন্ন ফসল এবং তার খাবার পশুপাখি ও মানুষ উভয়েরই জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
খাদ্য, পানি, ও বাতাসে মাধ্যমে গবাদি পশুর দেহেও প্লাস্টিকের কণা প্রবেশ করে। মাছের ভেতরেও মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে যথেষ্ট পরিমাণে। তাই স্বভাবতই মাংস বা মাছ খাওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের দেহে অনায়াসেই ঢুকে পড়ে এই ক্ষতিকর কণাগুলো।
২. মা থেকে শিশুতে
মাইক্রো প্লাস্টিক প্লাসেন্টার মাধ্যমে ভ্রূণে প্রবেশ করতে পারে। মাতৃত্বকালে মায়ের শরীরে এই কণা স্বল্প পরিমাণে থাকলেও বুকের দুধ পান করার সময় শিশুর দেহেও তা প্রবেশ করার আশঙ্কা থাকে। তবে প্লাস্টিক-জাত ফিডিং বোতল এবং চুষনীতে মাইক্রো প্লাস্টিক থাকার আশঙ্কা বেশি।
যে শিশুদের সাকশন কাপের মাধ্যমে বুকের দুধ খাওয়ানো হয়, সেই শিশুরা মাইক্রো প্লাস্টিক আক্রান্ত হতে পারে। প্রোপিলিন ফিডিং বোতলে তৈরি ফর্মুলা খাওয়ার মাধ্যমে শিশু উচ্চ মাত্রার মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসতে পারে।
দুধ পাম্প করে প্লাস্টিকের পাত্রে জমানো, তারপর তা গরম করার ফলে দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ বাড়ে। অনুরূপ ফলাফল পাওয়া যায় ওভেনে প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করার ক্ষেত্রেও। এখানে কেবল মাইক্রোপ্লাস্টিক-ই নয়, সেই সঙ্গে ন্যানোপ্লাস্টিকেরও (১ মাইক্রো মিটার বা তারচেয়েও ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা) ব্যাপন ঘটে।
৩. নিঃশ্বাসের মাধ্যমে
আহারের তুলনায় শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অনেক বেশি পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক দেহে প্রবেশ করে। গৃহস্থালির ধুলাবালি এই কণাগুলো ছড়ানোর একটি বড় উৎস। প্লাস্টিক কণাযুক্ত পরিবেশ বিপদের কারণ বাড়িয়ে দেয়। কেননা খাবার জীবাণু মুক্ত হলেও দূষিত পরিবেশে সেই খাবার খাওয়ার সময় অনায়াসেই মাইক্রোপ্লাস্টিক ফাইবার দেহের ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।
৪. ত্বক বা স্পর্শের মাধ্যমে
স্বাস্থ্যবান ত্বকে সাধারণত এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো প্রবেশ করতে পারে না। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বা নষ্ট ত্বক মাইক্রো প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে একদম উন্মুক্ত হয়ে থাকে। ত্বকে এসব ফাইবারের অনুপ্রবেশ ঘটে মূলত ঘাম এবং চুলের ফলিকলের মতো ক্ষত কিংবা ছিদ্রগুলোর মাধ্যমে। এছাড়া মুখে ব্যবহার করা নানা ধরনের প্রসাধনীর মাধ্যমেও এগুলোর ত্বকের প্রাচীর ভেদ করতে পারে।
ঘরের ভেতর থাকা ময়লা কার্পেট এবং সিন্থেটিক ফাইবার থেকে খুব কম সময়েই বাতাসে প্লাস্টিক কণার ঘনত্ব বেড়ে যায়। এতে করে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের ত্বক মাইক্রো প্লাস্টিকের সান্নিধ্যে আসে। এই দূষিত ধূলিকণার সংস্পর্শে বিশেষ করে বয়স্ক এবং শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
৫. শিল্প কারখানার উৎপন্ন বস্তু থেকে
পরিবেশে প্লাস্টিক কণার ছড়ানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্য পানি এবং নির্মানাধীন আবাসনের ভারী বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি। এভাবে দূষিত পরিবেশের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ মাইক্রো প্লাস্টিকের আগ্রাসনের শিকার হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে কল-কারখানা ও সেই নির্মানাধীন স্থানের কর্মীরা।
এসব উৎস ত্বক বা স্পর্শ ও নিঃশ্বাস উভয়ের মাধ্যমেই মানুষের আভ্যন্তরীণ শরীর ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। এখানে উৎপাদনকারী যন্ত্রাদির অপারেটরদের দেহে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার পরিমাণ থাকে সর্বাধিক। কারখানার ভেতরে যারা যন্ত্রগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে তারা আক্রান্ত হয় নিঃশ্বাসের মাধ্যমে। কেননা গোটা কারখানার পরিবেশে সার্বক্ষণিক প্রতিকূলতা বিরাজ করে। এক্ষেত্রে বিপজ্জনক স্থানগুলো হলো টেক্সটাইল শিল্প, ফ্লকিং শিল্প ও প্লাস্টিক শিল্প।
মানবদেহে মাইক্রো প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব
আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর ক্ষুদ্র কণাগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব বিভিন্ন পরিস্থিতির ভিত্তিতে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এগুলো হলো- আক্রান্ত আসার সময় ও স্থায়ীত্ব, কণার রাসায়নিক গঠন (ভারী ধাতু দ্বারা সমৃদ্ধ কি না) এবং একই সঙ্গে অন্যান্য দূষকের উপস্থিতি।
সামগ্রিকভাবে যেসব স্বাস্থ্য জটিলতার উপক্রম ঘটে সেগুলো হলো–
– ফুসফুসে প্রদাহ
– অক্সিডেটিভ স্ট্রেস
– কার্ডিওভাসকুলার ব্যাধি
– রক্তনালী-সংক্রান্ত রোগ
– শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা
– জ্বিনগত সমস্যা
– হরমোনজনিত সমস্যা
– কোষের ধ্বংস বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে নতুন কোষ তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটা
– ওজন বৃদ্ধি
– অ্যালার্জি সমস্যা
– দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যা
– রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে ক্যান্সারের দিকে পরিচালিত হওয়া
– প্রজনন জটিলতা
– শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ক্রমবিকাশে ব্যাঘাত ঘটা
– সাধারণ কোষের ক্যান্সার কোষে রূপান্তর
– বিপাকীয় জটিলতা