সব হাসপাতালে প্রয়োজন ‘ওসেক’, বাঁচবে হাজারও জীবন

দেশের হাসপাতালগুলোতে জরুরি সেবা আছে, তবে নেই ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস (ওসেক)। ফলে জরুরি চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে রোগের কারণ জানতেই লেগে যায় অনেক সময়। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ এই সময়টিতে আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন ইমার্জেন্সি সার্ভিসের মাধ্যমে দ্রুত রোগের কারণ নির্ণয় করে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া গেলে বেঁচে যেতে পারে হাজারও জীবন। আর বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে লাখো মানুষ।
এনটিভি অনলাইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান এসব কথা জানান।
ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, উন্নত বিশ্বে ‘ওসেক’ আছে। সেখানে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যায়। ফলে স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনা, হার্ট অ্যাটাকের মতো জটিল অনেক রোগী বেঁচে যায়। আমাদের দেশেও এটি সম্ভব। এরইমধ্যে ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ‘ওসেক’ আছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। ফলে অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় এসব হাসপাতালে দ্রুত রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে রোগীকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিসের (ওসেক) কথা তুলে ধরে ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, রোগীরা সেখানে ‘ওসেক’র সবচেয়ে ভালো সুবিধা পান। কারণ, সেখানে খুব গোছালো পদ্ধতিতে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ওসেক এমন একটি বিভাগ, যেখানে থাকবে একইসঙ্গে থাকবে ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, অক্সিজেনসহ ভেন্টিলেশন সুবিধা। পাশাপাশি থাকতে হবে উন্নত ল্যাব সুবিধাও, যেন জটিল রোগ নিয়ে কেউ এলেই জরুরি টেস্টগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এ ছাড়া মেডিসিন, সার্জারি, অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ নার্স, টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ একটি চিকিৎসাসেবা টিম। এতে করে কোনো রোগী এলে তাকে এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে দৌড়ে সময় নষ্ট করতে না হয়। এখানেই তার চিকিৎসাটা শুরু হবে। রোগ নির্ণয় করে প্রাথমিক করণীয় শেষে নির্দিষ্ট সময় পর তাকে নির্ধারিত বিভাগে পাঠানো হবে।
ঢাকার সিভিল সার্জন বলেন, এ সেবা দেশের সব হাসপাতালে দেওয়া গেলে হাসপাতালের ওয়ার্ডের ওপর রোগীর চাপও কমত। কারণ, যে রোগীর ভর্তির প্রয়োজন নেই, তাকে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিসের চিকিৎসার পরই বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া যেত। এতে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যও খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ডেভেলপ করত। চারদিকে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার সুনাম ছড়িয়ে পড়ত।
উদাহরণ হিসেবে ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, ধরেন, একজন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। তাকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে আনা হলো। দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে অর্থোপেডিক চিকিৎসকের কাছে রেফার করলেন। কিন্তু দেখা গেল তার বুকে আঘাত লেগে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার জন্য কিন্তু অর্থোপেডিক ডাক্তারই যথেষ্ট না। বুকের জমাট বাধা রক্ত বের করতে না পারলে তার শ্বাস নিতে সমস্যা হবে। তখনই সে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। অথচ ‘ওসেক’ থাকলে সেখানেই বুকের রক্ত জমাট বাধার বিষয়টিও খুঁজে বের করা সম্ভব। আর সেখান থেকেই নির্ধারণ হবে কোন চিকিৎসাটি আগে শুরু করতে হবে। প্রয়োজন হলে সব চিকিৎসা একই স্থান থেকেই শুরু করে রোগীকে একটি স্ট্যাবল পর্যায়ে এনে পরবর্তী সিদ্ধান্ত ‘ওসেক’র চিকিৎসকরা নিতে পারবেন।
ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, ধরুন কারও হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো। রোগীকে জরুরি বিভাগে আনা হলো। তার জরুরি ইসিজি করতে বলা হলো। তখন রোগীর সঙ্গে আসা এটেনডেন্ট ইসিজি রুম চিনে সেখানে যাওয়াটা অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। এতে রোগীর চিকিৎসা শুরু দেরি হয়, আর রোগীর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে থাকে। অনেক সময় বাঁচানো যায় না। অথচ প্রথম আধা ঘণ্টায় সঠিক চিকিৎসা শুরু করা গেলে এ জাতীয় রোগীর অনেককেই বাঁচানো সম্ভব।
এনটিভি অনলাইনের এক প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন বলেন, একটি আধুনিক মিনি ল্যাব স্থাপন এক্স-রে, ইজিসি, অক্সিজেন, আল্ট্রাসাউন্ড বা ইউএসজি, একটি মিনি অপারেশন থিয়েটার ও আইসিইউ সাপোর্ট কিন্তু সব হাসপাতালেই আছে। ‘ওসেক’ এর জন্য যে মেডিকেল টিম দরকার, তাও আছে। শুধু দরকার এক স্থানে আনা। সেক্ষেত্রে খরচ যে খুব বাড়বে বা এটি করতে অনেক বেগ পেতে হবে— বিষয়টি এমন নয়। দরকার সুন্দর একটি প্ল্যান ও তা বাস্তবায়ন।
‘ওসেক’ প্ল্যান কেমন হতে পারে প্রশ্নে ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, এখানে একজন রোগী এলে প্রথমে তাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- যার তেমন সমস্যা মনে হচ্ছে না, তাকে গ্রিন জোনে রেখে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ক্রিটিক্যাল রোগীকে রেড অ্যালার্টে রেখে রোগসংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে টিম ১০-২০ মিনিটের বেশি সময় পাবে না। এরপর থাকবে হলুদ বা ইয়েলো চিহ্নিত রোগী। তার জন্য ৩০-৬০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। আর সবশেষ থাকবে কালো বা ব্ল্যাকজোন। তার মানেই মৃত। যেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের আর কিছুই করার থাকে না।
মফস্বলের অনেক হাসপাতালে রোগীর তুলনায় চিকিৎসক ও সেবা প্রদানকারী অন্যদের সংখ্যা কম বলে দাবি করা হয়। সেখানে এই সার্ভিস চালু করা প্রসঙ্গে ঢাকার সিভিল সার্জন বলেন, চিকিৎসাসেবা উন্নত করতে অন্তত জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে প্রথমে এই সার্ভিস শুরু করতে পারলে হাজারও রোগী ঝুঁকিপূর্ণ সময়টিতে আধুনিক সুবিধা পেয়ে বেঁচে যেতে পারে। আর বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে লাখো মানুষ। বড় ধরনের ক্ষতি বলতে, পঙ্গুত্ব, অন্ধত্ব ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, আমি আশাবাদী মানুষ। পৃথিবীর উন্নত দেশ এই পদ্ধতিতে তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করে তুলেছে। আবার রোগীও এমন চিকিৎসা পেয়ে ভরসা খুঁজে পাচ্ছে। আমাদের দেশেও সব জেলা সদরে এই সুবিধা চালু করা গেলে ঢাকা-কেন্দ্রিক রোগীর চাপ কমবে। চিকিৎসাসেবা উত্তরোত্তর আরও উন্নত হবে।