বেপরোয়া ওসি প্রদীপ, টাকা না পেলেই দিতেন ক্রসফায়ারে
২০১৮ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগদানের পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮)। ওই সময়ে মাদক উদ্ধারের নামে শতাধিক ক্রসফায়ার করেন তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষকে নির্যাতন, ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ড, মামলা ও হামলা করে সাধারণ মানুষকে বাড়িছাড়া করার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেত না। শুধু তাই নয়, নারীদের যৌন হয়রানি করতেও পিছপা হননি তিনি। টেকনাফে গিয়ে প্রদীপের এসব অপকর্ম জেনে ফেলাই কাল হয়ে দাঁড়ায় সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের জন্য। এর সূত্র ধরেই ওসি প্রদীপ এবং তাঁর অনুগতদের হাতে ‘পরিকল্পিত’ ছকে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয় সিনহা মো. রাশেদকে।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে সাবেক ওসি প্রদীপ, তাঁর সহযোগী এবং সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা—সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। প্রায় এক বছরের শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষে আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি সোমবার আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল। মামলার শুনানিতে আসামিদের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।
মামলার অভিযোগপত্রের ১১ নম্বর পাতার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, মামলার এজাহারনামীয় ২ নম্বর আসামি প্রদীপ কুমার দাশ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানা থেকে ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে টেকনাফ মডেল থানায় যোগ দেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি মাদক নির্মূলের আড়ালে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ পেশিশক্তি প্রদর্শন এবং অন্যায় ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ী ছাড়াও স্থানীয় মোটামুটি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নিরীহ পরিবারকে নিশানা করেন। এরপর তাদের মিথ্যা মামলা জড়িয়ে, অনেক লোকজনকে ক্রসফায়ার দিয়ে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে আদায়ের নির্মম নেশায় লিপ্ত হন বলে জানা যায়।
ওসি প্রদীপের বিভিন্ন অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা একই পাতার তৃতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেন, তদন্তে আরও জানা যায়, তিনি (ওসি প্রদীপ) ২০১৮ সালের টেকনাফ থানায় যোগদানের পর তাঁর নেতৃত্বে ও নির্দেশে শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় বহু লোক মারা যায়। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধ প্রক্রিয়া (মডাস অপারেন্ডি) ছিল কোনো ঘটনায় মাদক উদ্ধার হলে অথবা টার্গেট কোনো ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হলে (ফিটিং মামলা) প্রথমত, আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর স্থানীয় কিছু শ্রেণির লোকজনসহ তাঁর নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের জন্য দেন-দরবার করা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ক্রসফায়ার না দেওয়ার শর্তে আদায় করা হতো। প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ আশানুরূপ বা চাহিদানুরূপ হলে ভিকটিমকে ক্রসফায়ারে না দিয়ে মাদক উদ্ধার দেখিয়ে উক্ত ব্যক্তির বা আসামির আত্মীয়-স্বজনদের মামলার আসামি করা হতো। এ ক্ষেত্রে নারী, বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী কেউ তাঁর আক্রোশ থেকে রেহাই পেত না। এমনকি নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও করা হতো বলে তদন্তে জানা যায় এবং এ ব্যাপারে আদালতে মামলা হয়েছে বলে জানা যায়। এরপর শুরু হতো তাঁর অন্যরকম অবৈধ অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, তাঁর দায়ের করা মামলার কথিত এজাহারে বর্ণিত আসামিদের ক্রসফায়ারের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ আসামির সৃজিত সম্পত্তি হতে বেদখল করে এবং ভয় দেখিয়ে মামলাপ্রতি লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করাই ছিল তাঁর নেশা ও পেশা। এ কাজ করার জন্য তিনি (প্রদীপ) তাঁর সমমনা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন।
অভিযোগপত্রের ১১ নম্বর পাতার শেষ অনুচ্ছেদে সাবেক ওসি প্রদীপ সম্পর্কে আরও উল্লেখ করা হয়—তাঁর এ ধরনের অপরাধকর্মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। যারা ন্যূনতম প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছে, তারা এবং তাদের পরিবার ও নিকটাত্মীয়-স্বজন তাঁর অত্যাচার, নিপীড়নসহ মামলা-হামলার শিকার হতো। তিনি টেকনাফ থানায় যোগদান করেই স্থানীয় কিছু দালাল শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং মাদক নির্মূলের অজুহাতে এবং নিজেকে সরকারের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক দেখানোর আড়ালে জনগণ তথা সরকারি দল-মতের তোয়াক্কা না করে পুরো থানা এলাকায় এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে সমাজ ও জনপদে ত্রাস সৃষ্টি করে অপরাধের অভয়ারণ্য এবং অপরাধ কর্মের রাজত্ব কায়েম করেছিল বলে জানা যায়। তাঁর এ ধরনের অপরাধ কর্মের প্রচার ও প্রসার রোধে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তাঁর দলবল স্থানীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে মুখ বন্ধ করে রাখতেন বলে জানা যায়। এতেও কাজ না হলে ভয়ভীতি, হুমকি প্রদর্শনসহ মামলায় জড়িয়ে কণ্ঠরোধ করা হতো। তাঁর কু-কর্মের বিষয়ে কেউ যাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে এবং প্রচার করতে না পারে সে বিষয়ে প্রদীপ কুমার দাশ ছিলেন খুব সোচ্চার ও সতর্ক। এবং এ ধরনের লোকজনের তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি তা২র থানায় এলাকাভিত্তিক সোর্স নিয়োগ করে রাখতেন।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান।
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) দুই নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে (৩০) তিন নম্বর আসামি করা হয়। বাকি ছয় আসামি হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫ কে। ৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা হলেন—লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।
র্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। তাঁরা হলেন—ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। তাঁদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন।
অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আদালত আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন।