২৫০ বছরের পুরোনো মাটির রাজপ্রাসাদ
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও জমিদারের তৈরি মাটির রাজপ্রাসাদটি এখনও রয়েছে অটুট। সংস্কার করায় রাজকীয় নকশা খচিত মাটির ডুপ্লেক্স বাড়িটি এখন পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তাই জমিদারের মাটির ডুপ্লেক্স বাড়িটি এক নজর দেখার জন্য প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসছে অসংখ্য মানুষ। ডুপ্লেক্স এই রাজপ্রাসাদ নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার মৈনম গ্রামে অবস্থিত। বর্তমানে বাড়িটির মালিক আসকার ইবনে সুলতান শান্ত। তিনি এর নাম দিয়েছেন রাইজিং হেরিটেজ প্যালেস।
আসকার ইবনে সুলতান শান্ত বলেন, ১৮২৩ সাল নাগাদ জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের বাবা পাল বংশের কাছে থেকে এই মাটির দোতলা বাড়িটি কিনেন। সেই সময়ে জমিদারির প্রায় সব কার্যক্রম চালানো হতো এই বাড়ি থেকেই। তখনকার রাজা-জমিদাররা খুব বেশি বিনোদনপ্রিয় ছিলেন। সেই সময়ে নির্মল বিনোদনের দিতে সুদূর ভারত থেকে শিল্পী নিয়ে এসে এই বাড়ির উঠোনেই বসত থিয়েটার, চলত যাত্রাপালাও। এখানে উচ্চ বংশীয় এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে পুঁজোর সময় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো। মৈনম বাজারের আধুনিক মাটির ডুপ্লেক্স বাড়িটি এখন ব্যক্তি মালিকানায় থাকলেও দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক আসেন বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
২০২১ সালে রায়বাড়ির শেষ বংশধর বরুণ রায় এবং বাবন রায় এই বাড়ি-জমি বিক্রি করে নাটোরে চলে যান। তাই ক্রয়সূত্রে বাড়িটির মালিক হন আসকার ইবনে সুলতান শান্ত। বাড়িটি সংস্কারে ও আধুনিকায়নে শান্ত স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের কারিগরদের শৈল্পিক কারিগরিকে অগ্রাধিকার দেন। এর সৌন্দর্য যেন সবাই উপভোগ করতে পারে তাই পর্যটকদের জন্য বাড়িটি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন মালিক শান্ত।
শান্ত বলেন, বাড়িটির বর্তমান নাম রাইজিং হেরিটেজ প্যালেস। এখানে এখনও সেই সময়ের মাটির চিহ্নগুলো রয়ে গেছে। বাড়ির দেয়ালগুলোতে মাটির স্তর দিয়ে নানা শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নিয়ামতপুরের আদিবাসি পল্লী থেকে ৮০-৮৫ বছরের বৃদ্ধ দ্বিজেন বর্মণ তাঁর ২০ জনের একটি দল নিয়ে চার মাস শিল্প কর্মের কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় কারিগর দিয়ে প্রায় দুই বছরের ব্যবধানে এমন রূপ দিতে পেরেছেন। বাড়িটিতে অভ্যন্তরীণ দুটি মাটির সিঁড়ি রয়েছে, যা প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো। আর সংস্কারের পর বাহির থেকে সবার চলাচলে সুবিধার্থে সিঁড়ি করা হয়েছে। প্রতিদিন মানুষ আসে মাটির এই ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেখতে।
কথিত রয়েছে, জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের দুই ছেলে ছিলেন। বড় ছেলের নাম বড়দা প্রসাদ রায় এবং ছোট ছেলের নাম শরৎ রায়। বড়দা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হতো বড় তরফ আর সারদা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হতো ছোট তরফ। এই বড়দা প্রসাদ রায় তৎকালীন (১৯৪২ সাল থেকে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত) এই এলাকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অর্থাৎ এখনকার ভাষায় যেটাকে বলা হয় চেয়ারম্যান। সেই সময়ে চেয়ার নিয়ে কথা বলার সময় এক মুসলিম ব্যক্তির ওপর মন্মথ রায়ের থুতু লেগে যায় আর এতে সেই সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর মোজাহার ডাকাত ও ইরফান ডাকাতের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেই দাঙ্গায় এই পরিবারের ১৩ জন সদস্য নিহত হন।
মৈনমের ১৯৬৪ সালের রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস একুশে পরিষদ নওগাঁ লিপিবদ্ধ করেছে। সে সময় জমিদার বড়দা প্রসাদ রায়ের স্ত্রীকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এই ঘটনায় বড়দা বাবু কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান। তিনি যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর রায় পরিবারের সদস্যরা এক এক করে বিভিন্ন জায়গায় চলে যান। সর্বশেষ এখানে ছিলেন বরুণ রায় ও বাবন রায়।
দর্শনার্থীরা বলেন, বাড়ি নওগাঁ সদরে হলেও এই বাড়িটির কথা অনেক শুনেছি। তাই আজ দেখার জন্য এলাম। এখন মাটির বাড়ি বিলুপ্তির পথে। এই বাড়িটি মাটির হলেও একটা রাজকীয় তথা জমিদারি ভাব আছে—যা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
আগত দর্শনার্থীরা হারানো এমন স্মৃতিকে ধরে রাখতে মোবাইলে ফোনে সেলফি তোলেন আবার অনেকে ভিডিও বানান।
স্থানীয়রা জানান, এই বাড়ির আগে এমন সৌন্দর্য ছিল না। গত বছর বাড়িটির সংস্কার ও নকশার কাজ শুরু করা হয়। যা সম্পন্ন হওয়ার পর অনেক দর্শনার্থী দেখতে আসে। বাড়িটির সামনের অংশে পানির ফুয়ারা, বসার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা যেন বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ পায় তাই এমনটা করা হয়ছে।