চলচ্চিত্র বাঁচাতে পারিশ্রমিক কমাতে রাজি শিল্পীরা
দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মন্দাভাব চলছে। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ। আর হালে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস যেন সব কিছুই ওলোট-পালোট করে দিয়েছে। প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল সিনেমা হল ও চলচ্চিত্র নির্মাণ। সম্প্রতি শুটিংয়ের অনুমতি মিলেছে। এরই মধ্যে অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিক কমানো নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। শীর্ষ অভিনয়শিল্পীদের অনেকে বলেছেন, চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে পারিশ্রমিক কমাতে রাজি তাঁরা। কারণ, অর্থের চেয়ে চলচ্চিত্রই তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান।
করোনা থেকে সুরক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিং করা জরুরি। তবে এ কারণে চলচ্চিত্রের বাজেটে যুক্ত হয়েছে নতুন খরচ। অন্যদিকে সিনেমা হল কমে যাওয়ায় আগের মতো দেড়-দুই কোটি টাকা হল থেকে তুলে আনা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। নির্মাণব্যয় কমিয়ে ৬০ লাখ টাকায় নিয়ে আসলে লগ্নীকৃত অর্থ ফেরত আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
নির্মাণ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলচ্চিত্রের বড় বাজেট চলে যায় শিল্পীদের সম্মানীতে। তাঁদের পারিশ্রমিক কমিয়ে আনার অনুরোধ করেছেন প্রযোজক-পরিচালকেরা। চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে এ নিয়ে চলছে আলোচনা।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিক কমিয়ে আনার মত চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারের। তিনি মনে করেন, এখন শিল্পীর সর্বোচ্চ সম্মানী পাঁচ লাখ টাকা হতে পারে।
মুশফিকুর রহমান গুলজার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা কম। দর্শকও হলে আসছে না। করোনার আগে বড় বাজেটের ছবিগুলো টাকা তুলে আনতে পারেনি। করোনার পর কী হবে বলতে পারছি না। তবে হিসাব করে দেখেছি, যে অবস্থা দাঁড়াবে তাতে কোনোভাবেই একটি ছবি থেকে ৬০ লাখ টাকার বেশি তুলে আনা সম্ভব নয়। এটা বলছি বড় তারকার ছবির কথা। সাধারণ মানের ছবি তো পোস্টারের টাকাও মার্কেট থেকে তুলে আনতে পারে না। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি শিল্পীদের পারিশ্রমিক কমাতে হবে। কারণ ছবির বড় একটা বাজেট চলে যায় তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে। একজন শিল্পীর সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেওয়া উচিত বর্তমান পরিস্থিতিতে।’
গুলজার আরো বলেন, ‘রাজ্জাক ভাই, শাবানা, ববিতারা চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে অনেক কম টাকায় কাজ করেছেন। এমনকি বিনা পারিশ্রমিকেও কাজ করেছেন তাঁরা। আমি এখনকার শিল্পীদের বলব, সবাই মিলে এখন চলচ্চিত্র রক্ষা করার সময়। চলচ্চিত্রের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন।’
চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম বলেন, ‘শুধু পারিশ্রমিক কম নিলেই হবে না। সময়মতো শুটিংয়ে অংশও নিতে হবে। আমরা এর আগে দেখেছি, শুটিং টাইম ৮টায়, তারকা সেটে আসলেন দুপুর ২টায়, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ৪টায় শুটিং করতে গেলেন। এখানে তাঁর জন্যই কিন্তু একদিনে ক্ষতি হয়ে গেল লাখ দুয়েক টাকা। তাঁরা সময়মতো শুটিংয়ে অংশ নিলে দুই কোটি টাকার ছবি এক কোটি দিয়ে শেষ হয়ে যাবে। চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।’
করোনা-পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে পারিশ্রমিক তিন ভাগের এক ভাগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের শীর্ষ অভিনেতা শাকিব খান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘করোনার পর অনেক প্রেক্ষাগৃহ খুলবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ৫০টি সিনেমা হল নিয়েই এগোতে হবে আমাদের । ভালো গল্প, ভালো পরিচালক, ভালো টেকনিশিয়ান আর একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী প্রযোজক থাকলে দরকার হয় আগের মতো দিনরাত পরিশ্রম করে শুটিং করব। পারিশ্রমিক নিয়ে এখন ভাবার সময় নয়।’
জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি আগে থেকেই ভাবছি। করোনার এই সময়ে আমাদের সবারই উচিত চলচ্চিত্রের পাশে দাঁড়ানো। যে কারণে আমি ৩০ শতাংশ পারিশ্রমিক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এত দিন আমি একটি ছবিতে ১০ লাখ টাকা নিয়েছি। এখন থেকে সাত লাখ টাকা নেব। আসলে আমাদের প্রতেকেরই নিজস্ব লাইফস্টাইল রয়েছে। সব দিকই মেনটেইন করতে হয়। তবুও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে আমি প্রস্তুত।’
চিত্রনায়ক ওমর সানী বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে এখন আমি সারা বছরই অভিনয়ের টাকা দিয়ে চলি। জীবন পরিচালনা করার জন্য এখন ব্যবসা করছি। তবে এই চলচ্চিত্রই আমাকে ওমর সানী বানিয়েছে। এর প্রতি ভালোবাসাটা অপরিসীম। চাই ভালো গল্পের ভালো চরিত্র, যেটাতে অভিনয় করে শিল্পী হিসেবে তৃপ্তি পাব। ছবির বাজেটে যে পারিশ্রমিক থাকবে, সেটি নিয়ে কাজ করতে সমস্যা নেই।’
মৌসুমী বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্রের এখন যে অবস্থা, অবশ্যই সবাইকে এক হয়ে কাজ করা উচিত। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে ছাড় দিতে দ্বিধা নেই। তবে ভালো গল্প নিয়ে কাজ করতে হবে। গল্পের চরিত্র আমার পছন্দ হতে হবে। অভিনয়টা আমার শুধু পেশাই নয়, এটি আমার নেশাও। মনের তাগিদেই ভালো কাজের অংশ হতে চাই। চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে যেকোনো সিদ্ধান্ত হাসিমুখে গ্রহণ করব।’
চিত্রনায়ক ফেরদৌস বলেন, ‘বেশি বেশি টাকা নিয়ে চলচ্চিত্রকে পথে বসিয়ে দেব, এমনটি আমি কখনো করিনি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আমি কম্প্রোমাইজ করেছি শুধু ভালো একটি চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার জন্য। টাকার বিষয়ে আমি কখনোই বিশেষ কোনো দাবি করে বসিনি। ফ্রিতে কাজ করেছি অনেক। চলচ্চিত্রের ক্লান্তিকালে এখন এটা দায়িত্ব, আমি চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে আমার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করব।’
চিত্রনায়ক বাপ্পী চৌধুরী বলেন, ‘আমিও তাই মনে করি। এখন চলচ্চিত্র রক্ষার জন্য আমাদের সবারই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। পারিশ্রমিক বিষয় নয়।
নিজের পারিশ্রমিক কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার সুদীপ্ত সাইদ খান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘করোনা বিপর্যয়ে চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচানোর লক্ষ্যে আমি আমার পারিশ্রমিক কমানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ৩০% কম পারিশ্রমিকে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে চাই। আগ্রহী পরিচালক-প্রযোজকগণ যোগাযোগ করতে পারেন।’