সবাই লিঙ্ক খুঁজলে ভালো কাজ আর হবে না : চঞ্চল চৌধুরী
গেল চার দিনে অন্তর্জালজুড়ে সবচেয়ে বেশি পড়া হচ্ছে একটিই নাম ‘তাকদীর’। তাই আর খুব লম্বা বাক্যে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’-এ মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিরিজ ‘তাকদীর’ সম্পর্কে। কারণ, ১৮ ডিসেম্বর মুক্তির পর থেকে সৈয়দ আহমেদ শাওকী পরিচালিত এই সিরিজে ‘তাকদীর’ হয়ে যে ক্যারিশমা দেখিয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, তা প্রশংসায় ভাসছে।
এত প্রশংসার পরও পৌষের ষষ্ঠ বিকেলে যখন চঞ্চল চৌধুরীকে চলভাষে পাওয়া গেল, তখন তাঁর কণ্ঠে যেমন উচ্ছ্বাস, তেমনই শোনা গেল বিব্রতকর ও খারাপ লাগার গল্প।
এ প্রান্ত ও প্রান্ত মিলিয়ে দীর্ঘ আলাপের প্রারম্ভে চঞ্চল চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া, দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো ঢোকা যাচ্ছে না, সবখানে সবাই ‘তাকদীর’ খুঁজছে। তো, দেশের বাইরে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? চঞ্চল শোনালেন, “ইন্ডিয়াতেও আমাদের দর্শক আছে। যেকোনো কাজ গেলে এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা ভালো লাগা মন্দ লাগার কথা লেখে। যেমন মীর (মীর আফসার আলী, রেডিও জকি, উপস্থাপক, অভিনেতা) দুটি স্ট্যাটাস দিয়েছে, সেখানে ওখানকার দর্শক রেসপন্স করছে খুব পজিটিভভাবে। ওদের ওখানেও যারা এসব নিয়ে লেখালেখি করে, সবাই কিন্তু পজিটিভ। ওদের কথাগুলোও এমন—‘হইচই’-এর বেস্ট প্রোডাকশন। এ ছাড়া ‘হইচই’-এর ওখানকার কর্তাব্যক্তিরা... তাঁরাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁরাও বলছেন প্ল্যাটফর্মের বেস্ট কাজ। এই বাংলায় আমরা সরাসরি প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি, ওই বাংলার সঙ্গে যতটুকু যুক্ত আছি, সেখান থেকেও পজিটিভ সবকিছু পাচ্ছি। এখানেও যেমন, ওখানেও তেমন...।”
‘তাকদীর’ মুক্তি পেয়েছে বাংলা ভাষায়। কিন্তু ডাবিং হয়েছে হিন্দি ও কলকাতার বাংলা অ্যাকসেন্টে। এটাকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই অভিনেতা। চঞ্চল চৌধুরী বললেন, ‘একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এখানে এক অ্যাকসেন্টের ভাষায় দেখছি, কলকাতায় ওখানকার অ্যাকসেন্টে দেখছে, আর একটি হিন্দি ভাষায় দেখছে। হিন্দিটা সমগ্র ইন্ডিয়া কাভার করছে। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। আমাদের ব্যাপ্তি বাড়ছে, দর্শক বাড়ছে।’
বাংলাদেশ-ভারতজুড়ে নিজের কাজের এত সফলতার পরও গেল তিন দিন ফেসবুকে ঢুকছেন না চঞ্চল চৌধুরী। ঢুকলে বিব্রত হচ্ছেন, খারাপও লাগছে তাঁর। একবুক হতাশা নিয়ে এনটিভি অনলাইনকে সেই গল্প চঞ্চল বলে গেলেন এভাবে, ‘আমরা আসলে এত দিন ফ্রি কনটেন্ট দেখতে দেখতে... আমাদের অভ্যাস এমন হয়ে গেছে, কোনো সিনেমা রিলিজ হলেও আমরা লিঙ্ক চাই। ইউটিউব লিঙ্ক চাই, এটা চাই, সেটা চাই... এটা তো আসলে ঠিক না। একটা ভালো কনটেন্ট যখন অনেক টাকাপয়সা খরচ করে তৈরি করা হয়, এটা যদি দর্শক লিঙ্ক থেকে দেখার চেষ্টা করে... একটা প্ল্যাটফর্ম সাবস্ক্রাইব করে দেখতে কয় টাকা লাগে? সারা বছরের সাবস্ক্রাইব ফি, এটা তো খুবই কম। দর্শক হিসেবে আমি ভালো কাজ চাইব, কিন্তু আমি সাহায্য করব না বা পকেটের একটি টাকা ব্যয় করব না... এমন টাকা তো না যে এটা নিজের বাড়িঘর বিক্রি করে দেখতে হবে। ব্যাপারটা তো তা না, খুবই সামান্য টাকা। এটা হচ্ছে মানসিকতার ব্যাপার।’
কণ্ঠে ক্ষোভ জড়িয়ে চঞ্চল আরো বললেন, ‘আমি ফেসবুকে দেখছি, কেউ কিছু লিখলেই সবাই লিঙ্ক চাচ্ছে। এটা খুবই বিব্রতকর এবং খুবই খারাপ লাগছে। তাহলে ভালো কাজগুলো আসলে কীভাবে হবে। সঠিকভাবে যদি আমরা কনটেন্ট দেখি, তাহলে সেটা আমাদের জন্য ভালো, প্ল্যাটফর্মের জন্যও ভালো। তাহলে একটা কালচার তৈরি হয়। ভালো কনটেন্ট দেখতে গেলে পকেটের একটু টাকা খরচ করলে আরো ভালো কিছু দেখার সুযোগ থাকে। এই সুযোগ আমরা যদি নষ্ট করে ফেলি...।’
এই অভিনেতা যুক্ত করেছেন, ‘আমাদের দেশের যাঁরা হইচই সাবস্ক্রাইব না করে দেখছেন, তাঁরা আসলে পাইরেসি কপি দেখছেন। পাইরেসি কপি কেন দেখছেন, এটা তো হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। আর সাবস্ক্রাইব করে দেখলে, প্ল্যাটফর্ম কিছু টাকা পেলে, সেই টাকা দিয়ে আবার ওরা বড় একটা কাজের বাজেট দিতে পারবে। যখন ওরা দেখবে আমাদের এখানে পাইরেসি হয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন আর টাকা লগ্নি করবে না। আমাদের দেশে যাঁরা পাইরেসি করে দেখছেন, তাঁরা কি একবারও এসব ভাবছেন? এ কারণে আমি আসলে আশাহত হচ্ছি।’
দর্শকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী বললেন, ‘সিনেমার ক্ষেত্রেও আমি একই কথা বলতাম একসময়। টাকা দিয়ে টিকেট কেটে সিনেমা না দেখলে ভালো সিনেমা হবে না। এ ক্ষেত্রেও সবাই এভাবে লিঙ্ক খুঁজলে ভালো কাজ আর হবে না, লগ্নি কোথা থেকে আসবে? একজন ভালো কাজের জন্য কোটি টাকা লগ্নি করবে, সেই টাকা উঠবে না, আমরা ওঠার ব্যবস্থা করে দেব না, দর্শক হিসেবে এটা তো আমাদের দায়। আমি ভালো কিছু দেখার জন্য বড় বড় বুলি দেব, এটা হচ্ছে না সেটা হচ্ছে না... দর্শকের কোনো দায়িত্ব নেই ভালো কাজের জন্য? তাঁর দায়িত্ব সঠিক নিয়মে কাজটা দেখা। সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখা আর ওয়েব কনটেন্ট হলে সেই প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখা।’
চঞ্চল চৌধুরীর এমন আক্ষেপের মাঝে এনটিভি অনলাইন জানতে চেয়েছিল, ‘তাকদীর’-এর সবকিছুই আমাদের, কিন্তু প্ল্যাটফর্ম অন্য দেশের। আমরা নিজেরা কেন পারছি না এমন কাজ উপহার দিতে? চঞ্চল চৌধুরীর ব্যাখ্যা, ‘এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা একটা মানের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারিনি। তিন-চার বছর ধরে বাংলাদেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। তারা কী করছে, ইউটিউব থেকে পুরোনো নাটক তুলে দিচ্ছে। তাদের আন্তর্জাতিক চিন্তা করতে হবে। তাদের পরিকল্পনা তো ওভাবে করতে হবে। এটা অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা, তাকদীরের মতো কাজ আমাদের দেশের একটা প্ল্যাটফর্ম থেকে হতে পারত। ভবিষ্যতে হতে পারে। এখন থেকে শিক্ষাটা নিতে পারি। গড়পড়তা কাজ করলে তো আর একটা টেলিভিশন হবে। আমাদের যে কয়টা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আছে বা আসছে, তাদের পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মানের না। বাজেট বা প্ল্যানিং কোনোটাই না। তাহলে আমি কীভাবে আশা করব, আমি আমাদের দেশে খুবই একটা ভালো কাজ দেব? আমি তো অবশ্যই চাই তাকদীরের মতো আরো ১০টা কাজ আমাদের দেশের প্ল্যাটফর্মে আসুক।’
চঞ্চল ইতি টানলেন এভাবে, ‘আর আমাদের প্ল্যাটফর্মে ভালো কাজ আসলেও দর্শক যদি তাঁর মানসিকতার পরিবর্তন না করেন, তাহলে আসলে কোনো প্ল্যাটফর্মই দাঁড়াতে পারবে না।’