শ্রদ্ধা
স্যার ক্রিস্টোফার লি, এক কীর্তিমান খলনায়ক

এ যুগের মানুষজন, যাঁরা ভিএইচএস যুগের ছবি দেখেননি, তাঁরা তাঁকে চিনবেন ভীষণ দুষ্টু এক লোক হিসেবে। লর্ড অব দ্য রিংস ট্রিলজির লর্ড সারোমান, যে অশুভ শক্তির প্রভাবে দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় আনতে চেয়েছিল। কড়া সিনেমাপ্রেমীদের কাছে তিনি কাউন্ট ড্রাকুলা অথবা জেমস বন্ডের খলনায়ক হিসেবে প্রিয়। স্যার ক্রিস্টোফার লি। খলনায়ক চরিত্রে অবিস্মরণীয় এক পুরুষ। গেল সপ্তাহে, ৭ জুন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ৯৩ বছর বয়সে।
তাঁর ছবির সংখ্যা শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে যে কারো। ২৭৮টি! ১৯৪৬ সালে ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ নামের একটি টিভি সিরিজে কাজ শুরু করেছিলেন, এ বছরেও ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি টেলস’ নামের একটি ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। আমৃত্যু ডুবে থেকেছেন কাজের মধ্যে। ছবির সংখ্যা তো এমন হবেই!
১৯২২ সালের ২৭ মে লন্ডনের বেলগ্রেভিয়ায় জন্ম নিয়েছেলেন ক্রিস্টোফার ফ্র্যাংক কারান্দিনি লি। জন্মসূত্রে মায়ের কাছ থেকে ইতালিয়ানরক্ত পেয়েছিলেন সাড়ে ছ’ফুট লম্বা এই দীর্ঘদেহী পুরুষ। ওয়েলিংটন কলেজে পড়ালেখার পর কেরানি হিসেবে লন্ডন শহরের বেশ কয়েকটি শিপিং কোম্পানিতে কাজ করেছিলেন তিনি। এভাবেই হয়তো জীবন চলে যেত। জীবন বদলানো শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে। সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। যুদ্ধশেষে অভিনয় জীবন শুরু। টেলিভিশন সিরিজ ক্যালাইডোস্কোপ নয়, তার প্রথম বড় মাপের কাজ বলা যেতে স্যার লরেন্স অলিভিয়ারের ‘হ্যামলেট’ (১৯৪৮)। এই ছবিতে সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি ছিল তাঁর।
এরপর সব বিখ্যাত অভিনেতাদের মতো তাঁরও শুরুর দিকের সংগ্রাম। এই সংগ্রামের সাথে সাথেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন একটু একটু করে। অভিনয় শিল্পীদের জীবনে ‘ব্রেক থ্রু’ যেটাকে বলে, তাকে সেই সাফল্য দিল ‘দ্য কার্স অব ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ (১৯৫৭)। এর পরের বছরই ‘হরর অব ড্রাকুলা’য় (১৯৫৮) কাউন্ট ড্রাকুলা চরিত্রে অভিনয় করে বাজিমাত করে দিলেন। সেই থেকে খলনায়কের দুনিয়ায় স্যার ক্রিস্টোফার লির আধিপাত্য শুরু।
১৯৭৪ সালে জেমস বন্ড সিরিজের ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান’ ছবিতে খলচরিত্র ফ্রান্সিসকো স্কারামাঙ্গা চরিত্রে অভিনয় করেন ক্রিস্টোফার। এ ছবিতে বন্ড ছিলেন রজার মুর। ছবিতে স্কারামাঙ্গার বিশেষ পরিচয় ছিল ‘পিস্তল স্কারামাঙ্গা’ হিসেবে। জেমস বন্ডের খলনায়করা সব সময়ই একটু ভিন্ন ঘরানার, তবে ক্রিস্টোফার ছিলেন আরো ভিন্ন! তিনি খলনায়ক হয়েও নায়কোচিত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন দারুণভাবে। জেমস বন্ড সিরিজের এক কিংবদন্তী খলনায়ক করে তুলতে পেরেছিলেন ‘পিস্তল স্কারামাঙ্গা’কে।
সবশেষে এ যুগে, ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস’ ট্রিলজিতে দেখা দিলেন সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত এক ভয়ঙ্কর জাদুকর লর্ড সারোমান হিসেবে। বৃদ্ধ বয়সেও দাপটের কমতি ছিল না সামান্যতম। গ্রাফিক্স, অ্যানিমেশন, ভিজুয়্যাল এফেক্ট আর সেট ডিজাইনিংয়ের ক্যারিশমায় ভরপুর ছবিতেও অভিনয় কীভাবে করতে হয়- দেখিয়েছেন বটে!
কোনো ধরনের চরিত্রকেই সামান্য করে দেখতেন না তিনি। ছোট থেকে বড়, সব ধরনের চরিত্রে গুরুত্ব দিয়ে অভিনয় করেছেন সব সময়। সেজন্যই হয়তো বলতে পেরেছিলেন, “একটা পুরনো দিনের রদ্দিমার্কা কথা আছে, ‘ছোট চরিত্র বলে কিছু নেই, তবে ছোট অভিনেতা আছে।’ কথাটা সত্য!” মহানায়কদের কথা আর কাজে এমনই মিল থাকে সব সময়।
খলনায়ক হয়েও যে সিনেমার ইতিহাসে তিনি অবিস্মরণীয় মহানায়ক!