চলচ্চিত্র পরিচালক সুপারম্যান না : রিয়াজুল রিজু
ভূমিকাটা এভাবে আরম্ভ করা যায়- তিনি এলেন, বানালেন এবং জয় করলেন। প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যাবেন- এমনটা তিনি ভাবতেই পারেননি কখনো। তাতে কী? সবাইকে অবাক করে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বলছি তরুণ নির্মাতা রিয়াজুল রিজুর কথা। ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর ছবি ‘বাপজানের বায়স্কোপ’ পেয়েছে সর্বোমোট নয়টি শাখায় পুরস্কার। এরমধ্যে রিয়াজুল রিজু জিতেছেন যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার।
সম্প্রতি রিয়াজুল রিজু মুখোমুখি হয়েছিলেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে। একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের জাতীয় পুরস্কার অর্জন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রসহ বেশকিছু বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
এনটিভি অনলাইন : প্রথম ছবিতেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে গেলেন। এই সাফল্যে ভাগ্য নাকি যোগ্যতা-কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন?
রিয়াজুল রিজু : আমার কাছে যেটা মনে হয়, একজন মানুষের সফলতার পেছনে তিন ধরনের বিষয় কাজ করে- যোগ্যতা, সময় ও ভাগ্য। এই তিন একত্রিত হলে ভালো কিছু অর্জিত হয়। আমার সময়টা গত দুই তিন বছর ধরে খুব খারাপ যাচ্ছিল। ছবি নির্মাণের জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আর্থিক সংকটের কারণে স্ত্রী-পুত্রকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। এমনও হয়েছে যে, এই ‘কারুকাজ’ পরিবারের যারা সদস্য আছে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তারা অনেক সহায়তা করছে ‘কারুকাজ’কে এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকিয়ে রাখতে। তবে এটা ঠিক যোগ্যতা ছাড়া কেউ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারে না। আর আমি কতটা যোগ্য সেটা দর্শক বিচার করবে। এই দায়িত্ব দর্শকের।
এনটিভি অনলাইন : এলেন, বানালেন এবং জয় করলেন। এটাকে জাদুকরী বললে কি ভুল বলা হবে?
রিয়াজুল রিজু : জাতীয় পুরস্কার অর্জনের পর অনেকে ভালোবেসে এমনটি বলছেন। আসলে ব্যাপারটি ঠিক এমন না। এই যে আমি এসেছি, বানিয়েছি এবং সবশেষ জয় করেছি-এর পেছনে একটি দীর্ঘ যাত্রা আছে। এই যাত্রা ছাড়া কোনো মানুষ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আসতে পারে না। আমার বংশে কেউ মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত নয়। আর সে কারণে আমাকে খুব সংগ্রাম করে এই জায়গাটায় আসতে হয়েছে। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি বলে আমার সংগ্রাম থেমে গেছে তা নয়। এখান থেকে আবার নতুন করে সংগ্রাম শুরু হলো। এভাবে চলতে থাকবে। এই সংগ্রাম ভালোকিছু করার সংগ্রাম।
এনটিভি অনলাইন : কেউ কেউ বলছেন ‘বাপজানের বায়স্কোপ’কে টেলিফিল্ম থেকে চলচ্চিত্রে রূপান্তর করা হয়েছে। সত্যি কি তাই?
রিয়াজুল রিজু : এই কথাটা ভুল। যাঁরা এমনটা বলছেন তাঁরা না জেনে বলছেন। মূলত আমি যখন চ্যানেলের প্রযোজক ছিলাম তখন ‘চারপাশ’ নামে একটি ডকুমেন্টারি ধরনের অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতাম। সেখানে বায়স্কোপওয়ালা নিয়ে একটি পর্ব করেছিলাম। ডকুমেন্টারিটি করার পর মনে হলো এটি নিয়ে আমি ফিকশন ধরনের কিছু করতে পারি। তবে এটা ঠিক প্রথমে আমার পরিকল্পনা ছিল টেলিফিল্ম নির্মাণের। তারপর যখন চিত্রনাট্য সাজালাম তখন মনে হলো এই টেলিফিল্মের বাজেট টেলিভিশন চ্যানেল দিতে পারবে না। তখন আমি এটাকে সিনেমাটিকভাবে চিত্রনাট্য সাজিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করি।
এনটিভি অনলাইন : তাহলে ঠিক কী কারণে এই অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ল বলে মনে করেন?
রিয়াজুল রিজু : এমন হতে পারে তখন আমি খুব কাছের কাউকে বলে ফেলেছি বায়স্কোপ আর চর নিয়ে একটি টেলিফিল্ম বানাব। সে হয়তো এটা দায়িত্ব সহকারে অপ্রপচার করেছে। (হাসি)
এনটিভি অনলাইন : জাতীয় পুরস্কারের জন্য সাধারণ বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র, যেগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ দেখতে পারে না এমন ছবিকে নির্বাচন করা হয়। আপনার ছবিটিও সর্বত্র পৌঁছায়নি। আপনার দৃষ্টিতে পুরস্কারের ক্ষেত্রে এমন ছবি নির্বাচন করা কতটা যৌক্তিক?
রিয়াজুল রিজু : যৌক্তিক আর অযৌক্তিকের বিতর্কে আমি যেতে চাই না। তা ছাড়া এ বিষয়ে আমার খুব একটা জানাশোনা নেই। জুরি বোর্ডের সম্মানিত সদস্যরা কিসের ভিত্তিকে সেরা নির্বাচন করেন সেটা আসলে আমি পরিষ্কার না। সে কারণে এটি নিয়ে কোনো রকম মন্তব্য করাটা যৌক্তিক হবে না।
এনটিভি অনলাইন : আপনার সঙ্গে যৌথভাবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পাওয়া মোরশেদুল ইসলাম বলেছেন ‘জুরি বোর্ডে যাঁরা থাকেন তাঁরা ফিল্ম কী জিনিস বোঝেন না’-এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
রিয়াজুল রিজু : আমার কাছে তো সেটা মনে হয় না। আমি মোরশেদুল ইসলাম ভাইয়ের ওপর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি এই কথার যৌক্তিকতা আছে কি না পুনরায় ভেবে দেখা প্রয়োজন। দেখুন, একজন সাধারণ দর্শক তো সিনেমা বোঝে। অন্তত দর্শক এটুকু বোঝে যে ভালো লেগেছে বা ভালো লাগেনি। যারা জুরি বোর্ডের সদস্য তারা কিছু বোঝে না এই কথা মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমি তাঁর সাথে একমত হতে পারলাম না। মোরশেদ ভাই অনেক জানাশোনা মানুষ। তিনি এ দেশের চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি যেটা বলেছেন সেটা বুঝেই বলেছেন। তাঁর কাছে হয়তো এমনটি মনে হয়েছে।
এনটিভ অনলাইন : মুক্তির পর আপনার ছবিটি প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। আপনি শুরু থেকে এর পিছনে রাজনীতির কথা বলে আসছেন। কেন এমনটি মনে হয়েছে?
রিয়াজুল রিজু : আমার কাছে এই ছবি হল থেকে নামিয়ে দেওয়ার পিছনে দুটি কারণ কাজ করছে-প্রথমত, কারুকাজ থেকে ছবি নির্মিত হোক, মাথা উঁচু করে কারুকাজ দাঁড়াক- এটা অনেক বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কাছে ভালো লাগেনি। দেখুন কারুকাজ এটি সমবায় সমিতির মতো। এখানে সদস্যরাই নিজেরা অর্থায়ন করে এটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটি খুব বড় কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান না। তবে এটা ঠিক কারুকাজ এগিয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, আমার ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের দেশবিরোধী শক্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে। যা দেশবিরোধী অপশক্তিদের ভালো লাগেনি। যার কারণে এটিকে হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এই দুটা ছাড়া আমি আসলে আর কোনো কারণ দেখি না।
এনটিভি অনলাইন : আপনি বারবার গণমাধ্যমে বলছেন সামনে হিট ছবি নির্মাণ করতে চান। প্রকৃতপক্ষে হিট ছবির সংজ্ঞা কী?
রিয়াজুল রিজু : যে ছবি সমগ্র দর্শকের কাছে পৌঁছাবে। দল বেঁধে মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে দেখবে। আবার দেখবে এবং আবার দেখবে। সেটাই হিট ছবি।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অস্থির অবস্থার মধ্যে হিট ফিল্ম নির্মাণ কতটা সম্ভব?
রিয়াজুল রিজু : খুব ভালো করে সম্ভব। তবে এর জন্য চাই একজন প্রকৃত প্রযোজক। অর্থলগ্নিকারী নয়। প্রযোজক এবং অর্থলগ্নিকারী এক নয়। অর্থলগ্নীকারী কেবল টাকা দেয়। এরা সিনেমা বোঝে না। টাকা দেয় সিনেমা বানায়। যিনি চলচ্চিত্র বিষয়টি খুব ভালো করে বোঝেন। মার্কেটিং বোঝেন। সিনেমার ব্যবসা বোঝেন, এমন একজন প্রযোজক প্রয়োজন। এই অল্প কয়েক বছরে আমি যতটা দেখেছি সেটা হলো, সিনেমার বাজারে আশি ভাগ হলেন অর্থলগ্নীকারী আর বাকি বিশ ভাগ হলেন প্রকৃত প্রযোজক। তা ছাড়া পরিচালকই যে সব কিছু করবেন এটা ঠিক না। তাঁরা সুপারম্যান না যে,তাঁরা ছবির প্রোডাকশন থেকে আরম্ভ করে মুক্তি দেওয়া পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন। একজন পরিচালকের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সেক্ষেত্র প্রযোজক যদি বুদ্ধিমান এবং ব্যবসা বোঝেন তাহলে সিনেমা হিট হতে বাধ্য।
এনটিভি অনলাইন : দেশীয় চলচ্চিত্রে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। কোনদিকে যাচ্ছে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প?
রিয়াজুল রিজু : আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প এখনো ধ্বংস হয়ে যায়নি। হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। খারাপ সময় আসতেই পারে তাই বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলে হবে না। সবাইকে একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের আবার সুদিন ফিরবে। শুধু একটু সময় লাগবে। আমি আশাবাদী মানুষ। আশা ছাড়তে চাই না।