সর্বকালের বিতর্কিত ১০ চলচ্চিত্র
একটি সিনেমা একজন পরিচালককে যেমন এনে দিতে পারে খ্যাতি আর প্রশংসা, সেই সঙ্গে করে তুলতে পারে বিতর্কিতও। ধর্ম, রাজনীতি কিংবা মানবতাবোধের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক নির্মাতাই সতর্ক থাকেন। তবে সব পরিচালক তো আর এসবের পরোয়া করেন না। বিশেষ করে বিখ্যাত পরিচালকদের ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি করা তো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। অনেক ছবির জন্য তাঁরা যেমন প্রশংসিত হয়েছেন, সেই একই ছবির জন্য খুনের হুমকিও পেয়েছেন—আর জেল-জরিমানা তো ছিলই। ইতিহাসজুড়ে থাকা তেমনই কিছু বিতর্কিত সিনেমার একটি তালিকা প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’। তালিকার সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ১০ সিনেমার বিস্তারিত থাকছে এই আয়োজনে।
১. আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ (যুক্তরাজ্য, ১৯৭১)
কিংবদন্তি নির্মাতা স্ট্যানলি কুব্রিক এই সিনেমার পরিচালক। অ্যান্থনি বার্জেসেরে উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমা চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে সহিংস ছবির মধ্যে অন্যতম স্থান নিয়ে রয়েছে। এ ছবির প্রোটাগনিস্ট অ্যালেক্স হিসেবে ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয় করেন ম্যালকম ম্যাকডওয়েল। তবে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় আর ছবির বিষয়বস্তু হজম করা যে কারো জন্য কঠিনই বটে। হত্যা, ধর্ষণ আর শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও ছবিটি বিষয়বস্তুগত দিক থেকেই হজম করা বেশ কঠিন। স্ট্যানলি কুব্রিকের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বেশ কিছু জায়গায় নিষিদ্ধ ছিল এই সিনেমা।
২. দ্য লাস্ট হাউস অন দ্য লেফট (যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭২)
ওয়েস ক্র্যাভেনের ক্যারিয়ারের প্রথম নির্মাণ এই সিনেমা। ভয়ংকর একদল অপরাধী কিডন্যাপ করে কিশোর দুই বন্ধুকে আর বাধ্য করে একজন আরেকজনের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতে। নির্যাতন, অঙ্গচ্ছেদ আর ধর্ষণ দৃশ্যের কারণে প্রচণ্ড বিতর্কের মুখে পড়েন নির্মাতা। কথিত আছে যে, বেশ কিছু দৃশ্য ধারণের একপর্যায়ে মানসিকভাবে প্রচণ্ড পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন অভিনেত্রী সান্দ্রা পিবডি। তিনি নাকি সেট ছেড়েও চলে গেছেন অনেকবার।
৩. লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস (ফ্রান্স/ইতালি, ১৯৭২)
কতটা বিতর্কিত হলে কোনো সিনেমার জন্য জেল খাটতে হয় পরিচালককে? তাঁর কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি হয়তো নেই। কিন্তু ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ নির্মাণের দায়ে পরিচালক বার্নার্দো বের্তোলুচ্চিকে জেল খাটতে হয়েছিল চার মাসের জন্য। এ সিনেমার সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং সমালোচিত দৃশ্যটি ‘বাটার সিন’ নামে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জায়গা নিয়ে আছে। ছবিটি প্রায় ৩০ বছর ইতালি, পর্তুগাল, চিলিসহ বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ ছিল।
৪. দি এক্সরসিস্ট (যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭৩)
উইলিয়াম ফ্রিডকিনের এই হরর ক্ল্যাসিক-এর গল্পের কেন্দ্রে এক কিশোরী, যাকে আবিষ্ট করে এক অশরীরী আত্মা। হলিউড সমালোচকরা এই সিনেমাকে আখ্যায়িত করেন ‘রিলিজিয়াস পর্ন’ হিসেবে। মুক্তির পরপরই যা তকমা পায় ‘সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ানক সিনেমা’র। অভিযোগ করা হয়, সিনেমার এডিটরদের কারসাজি এতটাই তীব্র, যা ভয়াবহ প্রভাব ফেলে দর্শকের অবচেতন মনে। ১৯৮৪ সালের ভিডিও রেকর্ডিং অ্যাক্টের বাস্তবায়নের পর সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ হয়ে যায় ‘দি এক্সরসিস্ট’-এর বিপণন ও প্রদর্শন। তবুও সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম হরর হিসেবে এখনো আখ্যা দেওয়া হয় এই ছবিকে।
৫. সালো অর দ্য হান্ড্রেড টোয়েন্টি ডেইজ অব সডম (ইতালি, ১৯৭৫)
ফ্যাসিবাদী ইতালিতে একদল তরুণ-তরুণীকে অপহরণ করে তাদের বীভৎসভাবে মনোদৈহিক নির্যাতন করার দৃশ্যায়ন এই পুরো ছবিতে। সর্বকালের সবচেয়ে ‘ডিস্টার্বিং’ ছবি হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয় এটিকে। প্রখ্যাত নির্মাতা পিয়ের পাওলো পাসোলিনির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিতর্কিত এই ছবি মুক্তির পর নিষিদ্ধ হয় অনেক দেশে। এই নিষেধাজ্ঞা অনেক জায়গায় আজো বলবৎ! সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়, এই ছবি নির্মাণের কিছুদিন পরই হত্যা করা হয় পাসোলিনিকে।
৬. আই স্পিট অন ইউর গ্রেভ/ ডে অব দ্য উইমেন (যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৭৮)
এক দুর্ভাগা সাঁতারু শিকার হয় ধর্ষণের, তার পর প্রতিশোধ নেয় একে একে হত্যা করে। যার ফলে চলে আসে ফাঁসিতে ঝোলানো, কুড়াল দিয়ে হত্যার মতো ভয়াবহ দৃশ্যগুলো। মুক্তির আগে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কাটছাঁট করা হয় সিনেমার। আয়ারল্যান্ড, জার্মানিসহ অনেক দেশে ছবিটিকে নিষিদ্ধও করা হয়।
৭. মন্টি পাইথন’স লাইফ অব ব্রায়ান (যুক্তরাজ্য, ১৯৭৯)
স্বভূমি ছেড়ে যাওয়া নায়ক ব্রায়ান আর যিশুখ্রিস্টের সমান্তরাল জীবনের কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই সিনেমা। যেখানে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে দেখানো হয় হাস্যরসাত্মকভাবে। মুক্তির পর যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অজুহাতে দাবি করে সিনেমাটি নিষিদ্ধ করার। বিতর্কিত এই সিনেমায় জুডিথ ইস্ক্যারিওটের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মামলা করা হয় অভিনেতা জোনস ডেভিসের বিরুদ্ধে। পরবর্তী সময়ে তিনিই মেয়র নির্বাচিত হয়ে তাঁর শহরে এই সিনেমার ওপর থাকা ৩০ বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
৮. কিডস (যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯৫)
নামে ‘কিডস’ হলেও কোনো মা-বাবাই চাইবেন না, তাঁর সন্তান এই সিনেমা দেখুক! এইডস আক্রান্ত ১৭ বছরের এক কিশোর অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয় অনেকের মাঝে। ড্রাগস, যৌনতা আর সহিংস আচরেণে ভরপুর হলেও ল্যারি ক্লার্কের এই ছবি বোদ্ধাদের কাছে পেয়েছে প্রশংসা।
৯. বাইসে-মোয়া (ফ্রান্স, ২০০০)
ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে যায় আজন্ম নির্যাতনের শিকার দুই নারী নাদিন আর মানুর। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে একসঙ্গে শুরু করে তাদের খুনের যাত্রা। এ নিয়েই গল্প ‘বাইসে-মোয়া’র। গ্রাফিক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, নৃশংসতা থাকলেও সিনেমাটির বিতর্ক মূলত দুই অভিনেত্রীকে ঘিরে, যারা একসময় পর্নো তারকা ছিল। কিছু কাটছাঁটের পর ব্রিটেনে সিনেমাটি প্রদর্শনের অনুমতি পেলেও সংবেদনশীলতার কারণ দেখিয়ে নিষিদ্ধ করা হয় এর পোস্টার।
১০. অ্যান্টিক্রাইস্ট (ডেনমার্ক, ২০০৯)
কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শন হয় সিনেমাটির, প্রদর্শনীতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন চারজন দর্শক। নির্মাতা লার্স ভন ট্রিয়ারের এই সিনেমার কাহিনী এক দম্পতিকে নিয়ে, যাদের যৌনমিলনের সময় জানালা দিয়ে ছিটকে পড়ে মারা যায় তাদের শিশুসন্তান। ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে শিশুটির মা এবং ঘটাতে শুরু করে নানান ভয়াবহ আর অসুস্থ ঘটনা। প্রমোভুই নামক ক্যাথলিকদের একটি দলের প্রতিবাদের মুখে ২০১৪ সালে ফ্রান্সে নিষিদ্ধ হয় ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’। পরে একই পথ অনুসরণ করে আরো কয়েকটি দেশ। চলচ্চিত্র সমালোচক সুখদেভ সান্ধু এই ছবিকে আখ্যায়িত করেন ‘টর্চার পর্ন’ হিসেবে।